তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে

প্রবাদটি মহাভারতের। হিন্দুদের অবতার শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব এবং বেড়ে ওঠা সম্পর্কে তৎকালীন জ্যোতিষেরা রাজা কংসকে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন- সেটারই অপভ্রংশ বাংলা ভাষায় দাঁড়িয়েছে 'তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।' সে অনেক পুরনো কথা- কম করে হলেও পাঁচ হাজার বছর তো হবেই। শ্রীকৃষ্ণ সে সময় ভারতবর্ষে ছিলেন, ঠিক একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন মুসলমান জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আঃ)। 

আলোচ্য প্রবাদটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল- মানুষ তার নিয়তির অমোঘ পরিণতি থেকে কোনভাবেই রক্ষা পায় না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মানুষকে লক্ষ্য করে বলেছেন, 'জীবনের সমস্ত দুর্ভোগ তোমাদের দু'হাতের কামাই।' কোরআনের অমিয় বাণী, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের নীতিকথা এবং হাজার হাজার বছরের মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা স্পষ্ট যে, মানুষের কর্মই তার পরিণতি ডেকে নিয়ে আসে এবং একবার পরিণতি যদি ডাক দেয় তাহলে আর ফেরার পথ থাকে না। ইতিহাসের কয়েকটি নির্মম পরিণতির বিবরণ দিয়ে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ফিরে এলেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন নিয়তি কিভাবে মানুষকে ডাকে। 


রাজা কংস তার রাজজ্যোতিষীর মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তার নববিবাহিত বোন দেবকী এবং তার স্বামী বাসুদেবের ঔরসজাত সন্তানই হবেন তার হত্যাকারী এবং সিংহাসন দখলকারী। কংস এই ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে দেবকী ও বাসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন। কিন্তু কারারক্ষীরা দয়াপরবশ হয়ে মাঝে মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ব্যবস্থা করে দিত। ফলে দেবকী গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং কারাগারেই কংসের অজান্তে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দেন। ভীতসন্ত্রস্ত কারারক্ষীরা শিশু শ্রীকৃষ্ণকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সুদূর গ্রামাঞ্চলের জনৈক গোয়ালের ঘরে রেখে আসে লালন-পালনের জন্য। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ যখন গোয়াল-গোয়ালিনীর ঘরে বেড়ে উঠেছিলেন, তখন রাজা কংস তাচ্ছিল্যভরে রাজজ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলেন- কি হে তোমার ভবিষ্যদ্বাণীর কি হল। উত্তরে রাজজ্যোতিষী বললেন, 'তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে'- পরবতর্ী ঘটনা কমবেশি সবারই জানা, রাজা কংসের সীমাহীন অত্যাচার, অবিচার, হত্যা, নির্যাতন রাজ্যময় মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তোলে। এই বিদ্রোহীরাই যুবক শ্রীকৃষ্ণকে তাদের নেতা মনোনীত করে এবং তার নেতৃত্বে কংসকে নিহত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এখন পর্যন্ত কোন নিষ্ঠুর আত্দীয়কে ব্যঙ্গ করার জন্য আমরা কংস মামা শব্দটি ব্যবহার করি। 


নিয়তির আরও একটি নির্মম পরিহাসের ঘটনা ঘটেছিল খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। আজকের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটানের কাছে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যদি শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় ভুটানের রাজার কাছে নীত হন তাহলে বিশ্ববাসী যেরূপ হতভম্ব হবে, ঠিক তদ্রূপ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল তাবৎ বিশ্ব, যেদিন লিডিয়ার রাজা ক্রিসাস মিডিয়ার রাজা সাইরাসের কাছে পরাজিত এবং বন্দি হয়েছিলেন। ভূমধ্যসাগরের দুই তীরের দুই রাজা। ইউরোপের অংশের নাম লিডিয়া। রাজার নাম ক্রিসাস। আজকের গ্রিসসহ প্রায় সব ইউরোপীয় রাজ্য ছিল লিডিয়ার অধীন বা করদরাজ্য কিংবা প্রভাবযুক্ত। প্রায় ২০০ বছর ধরে রাজা ক্রিসাসের বংশ একাদিক্রমে এই বিরাট সাম্রাজ্য শাসন করছিলেন এবং ক্রিসাস ছিলেন এই রাজপরিবারের সর্বোৎকৃষ্ট, যোগ্য এবং মহান শাসক। অন্যদিকে মিডিয়া ছিল এশিয়ায়। আজকের ইরান বা পারস্যের পার্সি পলিসে ছিল এর রাজধানী যা দীর্ঘদিন লিডিয়ার করদরাজ্য ছিল। সাইরাসই প্রথম কর দেয়া বন্ধ করে দেন এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে আশপাশের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র দখল করে রাজ্যের পরিধি বাড়ান। 


মিডিয়ার রাজা সাইরাসের তৎপরতায় সম্রাট ক্রিসাস খুবই বিরক্ত হলেন এবং যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। পৃথিবীকে হতবাক করে দিয়ে স্বল্পকালীন যুদ্ধে ক্রিসাস পরাজিত, বন্দি এবং মৃতু্যদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। হুকুম হল শিকলবদ্ধ অবস্থায় জ্বলন্ত চিতায় ক্রিসাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। সে মতে ক্রিসাসকে চিতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, দূর থেকে বিজয়ী রাজা সাইরাস দেখলেন যে, রাজা ক্রিসাস কি যেন আপন মনে বিড়বিড় করে বলছেন। সাইরাস খুবই আশ্চর্য হলেন। কারণ তৎকালীন বিশ্বের রেওয়াজ অনুযায়ী মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত সাহসীরা বিজয়ী রাজাকে গালাগাল দিতেন। অন্যদিকে ভীরু বা কাপুরুষরা প্রাণভয়ে হাউমাউ করে কাঁদতেন এবং প্রাণভিক্ষা চাইতেন। এর কোনটা না করে সম্রাট ক্রিসাস যখন আপন মনে বিড়বিড় করছিলেন তখন রাজা সাইরাস জানতে চান যে, বিড়বিড় করে আসলে কী বলা হচ্ছে। ক্রিসাস উত্তর করলেন- আমি তেমন কিছু বলছি না। কেবল আমার শাসনকালীন শেষ সময়ের একটি স্মৃতি স্মরণ করে বলছি- এই কি নিয়তি! এই কি ভাগ্য! রাজা সাইরাস যখন ক্রিসাসের সেই স্মৃতি জানতে চান তখন নিম্নের চমৎকার ঘটনাটি প্রকাশিত হয় যা ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস তার হিস্টিরিয়া গ্রন্থে আরও চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। 


ক্রিসাস বলেন- ঘটনাটি এই যুদ্ধযাত্রার কিছুদিন আগের যখন আমি এবং আমার রাজ্য সফলতার স্বর্ণশিখরে অবস্থান করছি। ২০০ বছরের পারিবারিক ঐতিহ্য, সঞ্চিত ধনরাশি, রাজ্যময় সুখ-শান্তি ও শৃঙ্খলা সর্বোপরি আমার সুস্বাস্থ্য, জ্ঞানগরিমা, প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা এবং পারিবারিক শান্তি নিয়ে আমি ছিলাম আত্দতৃপ্তিতে মগ্ন এবং একই সঙ্গে গর্বিত এবং আহ্লাদিত। এমন সময় আমার জনৈক মন্ত্রী আমাকে খবর দিলেন যে, বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী এবং পর্যটক রাজধানীতে অবস্থান করছেন। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ দিতে আগ্রহী কিনা। আমি সানন্দে রাজি হলাম এবং ওই মহান জ্ঞানী পর্যটককে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালাম। খাবার টেবিলে বসার আগে আমার হুকুম মতো আমার লোকেরা জ্ঞানী মেহমানের কাছে আমার পরিবারের ২০০ বছরের বর্ণাঢ্য গৌরবগাথা বর্ণনা করল। ঘোড়াশালে এবং হাতিশালে নিয়ে পৃথিবীর সুন্দরতম এবং শক্তিশালী হাতি-ঘোড়া দেখাল। রাজকোষ উন্মুক্ত করে ২০০ বছরের সঞ্চিত বিপুল ধনরাশি দেখানো হল। অন্তঃপুরে নিয়ে আমার স্ত্রী এবং হাজার হাজার দাসদাসীকে দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজপ্রাসাদের আরও অন্যান্য ঐতিহ্য ও জৌলুসতা দেখানোর পর খাবার টেবিলে আনা হল। শত পদের আয়োজন এবং সব রকমের জাঁকজমকপূর্ণ আড়ম্বর পরিবেশে উত্তম পোশাক পরিধান করে আমি তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। অতীতের মেহমানদের মতো আমি তাকে আবেগাপ্লুত কিংবা আমার ব্যাপারে কৌতূহলী দেখলাম না। অনেকটা নির্লিপ্তভাবে তিনি আমার অভ্যর্থনা গ্রহণ করে খেতে বসলেন। আমি বেশ আশাহত ও বিমর্ষ হলাম। এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- মহাত্মন
, আপনি তো সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন! আপনার দেখা কিংবা জানামতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি কে? আশা ছিল তিনি আমার নামটি বলবেন, কিন্তু না, তিনি একজন অখ্যাত ব্যক্তির নাম বললেন। আমি দ্বিতীয় সুখী মানুষের এবং পরে তৃতীয় সুখী মানুষের নাম জিজ্ঞাসা করলে এবারও তিনি অখ্যাত দুই ব্যক্তির নাম বললেন। আমি ধৈর্য হারিয়ে রাগতস্বরে বললাম- আপনি তো দেখছি খুবই হিংসাপরায়ণ ও বাজে প্রকৃতির মানুষ! আমার ২০০ বছরের রাজপরিবারের সফলতার ইতিহাস, আমার নিজের সাফল্যজনক ১৭ বছর রাজত্বের ইতিহাস, অঢেল ধনসম্পদ, সুন্দর স্বাস্থ্য, সুন্দরী স্ত্রী, যোগ্য সন্তান-সন্ততি, শক্তিশালী রাষ্ট্র কাঠামো এবং সর্বোপরি সুখী প্রজাদের দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে আমি খুবই অসুখী মানুষ? জ্ঞানী ব্যক্তির কোন ভাবান্তর হল না। তিনি উত্তর করলেন- 'হুজুর! রাগ করবেন না। আমি যে ৩ ব্যক্তির নাম বলেছি তারা সবাই মৃত। কোন জীবিত ব্যক্তিকে কখনও সুখী কিংবা দুঃখী বলা যায় না কারণ জীবনসায়াহ্নের যে কোন একটি ঘটনা ব্যক্তির সারা জীবনের সফলতাকে ম্লান করে তাকে একজন দুঃখী ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারে। আবার সারা জীবনের দুঃখের পর শেষ জীবনের একটি সফলতা তাকে সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত করতে পারে। পণ্ডিত ব্যক্তির উত্তর শুনে আমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম এবং বললাম- আপনি তো দেখছি খুবই পাঁজি প্রকৃতির হিংসাপরায়ণ লোক! আমি এত আদর, এত সম্মান দেখিয়ে আপনাকে ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানালাম আর আপনি কিনা কামনা করছেন জীবনের শেষ প্রান্তে একটি দুর্ঘটনা আমার সব সফলতা ধ্বংস করে আমাকে একজন দুঃখী মানুষে পরিণত করে ফেলবে! আমি জ্ঞানী পর্যটককে দূর দূর করে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলাম এবং রাজ্য থেকে বহিষ্কার করলাম। আজ এই জ্বলন্ত চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আমার কেবল সেই মহান পণ্ডিতের উক্তিই মনে পড়ছে! 

বিজয়ী রাজা সাইরাসও ছিলেন মহাজ্ঞানী এবং ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহানায়ক। সম্রাট ক্রিসাসের আত্দোপলব্ধি তাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করল। তিনি অনুমান করলেন নিশ্চয়ই সম্রাট ক্রিসাস অত্যন্ত উঁচুমানের মানুষ এবং এই পৃথিবীর জন্য এ ধরনের মানুষ খুবই দরকার। তিনি ক্রিসাসের মৃতু্যদণ্ড মওকুফ করে তাকে তার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করলেন। 


উপরোক্ত দুটি ঐতিহাসিক উপাখ্যানের বিস্তারিত বিবরণ, ব্যাখ্যা এবং তাৎপর্য বর্ণনা করতে গেলে হাজার পৃষ্ঠায়ও শেষ করা যাবে না। দুটি ঘটনাই আংশিক বা খণ্ডিতরূপে বর্ণিত হয়েছে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন এ উপাখ্যানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান মানুষদের আমি মূলত কী বুঝাতে চাচ্ছি? সরল বাংলায় বলতে গেলে আমি বলব মূলত নিয়তি বা পরিণাম কিভাবে মানুষের জীবনে আসে তার দুটি ভিন্ন আঙ্গিক প্রকাশ পেয়েছে ঘটনা দুটিতে। প্রথমটিতে কংস নিজের অত্যাচার, অবিচার ও অনাচার দ্বারা তার নিয়তিকে ডেকে এনেছেন। অন্যদিকে সম্রাট ক্রিসাস সব দিক থেকে যোগ্য বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও অনাহূত ও অপ্রয়োজনীয় হিংসার বশবতর্ী হয়ে তার পতন ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে লিডিয়া সম্রাটের কোন প্রয়োজনই ছিল না সাগরের ওপারের ক্ষুদ্র রাজ্য মিডিয়া আক্রমণের। গল্পের অন্য একটি প্রতিপাদ্য বিষয় হল প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যক্তি নিজের পতন নিজেই ডেকে নিয়ে আসে। অর্থাৎ ব্যক্তি নিজ কিংবা তার পারিপাশ্বর্িক পাত্রমিত্ররাই পতনের মূল নায়ক। বাইরের লোক বা পক্ষ এক্ষেত্রে কেবল সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে। 


সত্তরের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, সরকারগুলোর পতন তার নিজেদের লোকদের দ্বারাই হয়েছে। যেমন ধরা যাক এরশাদ সরকারের পতনের কথা। এরশাদ যেদিন পদত্যাগ করলেন তার একদিন আগেও আমরা কেউ জানতে পারিনি আগামীকাল কী হতে চলেছে। এরশাদের নিয়োগকৃত সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন খান মূলত জামায়াত লবির বিএনপিঘেঁষা লোক ছিলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি এরশাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। এরশাদের পতনের পর তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন বিএনপির মনোনয়ন নেয়ার জন্য। কিন্তু নরসিংদীর যে আসনে তিনি মনোনয়ন চাচ্ছিলেন সেখানে সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের মতো শক্তিশালী প্রাথর্ী থাকায় তিনি সুবিধা করতে পারেননি। পরে দেখা গেল জেনারেল খান আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলেন এবং মন্ত্রীও হলেন। 


এরশাদের আগে বিচারপতি সাত্তার সরকারের পতন ছিল নানা নাটকীয়তায় পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার রাজনীতির এক কলংকময় অধ্যায়। সাত্তার মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য গোপনে এরশাদের সঙ্গে অাঁতাত করে দৃশ্যত বৃদ্ধ বিচারপতিকে নিঃসঙ্গ বানিয়ে ফেলেন। আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন বাইরের শক্তি সেদিন বিএনপির পতন ঘটায়নি। বিএনপিই বিএনপির পতন ঘটিয়েছিল। কেন এরূপ হয়েছিল তা বর্ণনা করতে আবার অন্য প্রসঙ্গে যেতে হবে। এবার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে আসি। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর এবং অন্যান্য অফিসারকে প্রত্যক্ষভাবে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। জেনারেল মঞ্জুর রাষ্ট্রপতি জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহযোদ্ধা এবং সহযোগী ছিলেন। জেনারেল জিয়া সেদিন চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন মূলত চট্টগ্রাম বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্য। রাতে ক্যান্টনমেন্টের বৈঠকটি জিয়ার সফরের কর্মসূচিতে পূর্বনির্ধারিত ছিল না। তার সফরসঙ্গীদের অনেককে তার হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্দেহ করা হয়। এমনকি পারিবারিক লোকজনও সন্দেহের ঊধের্্ব নন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় আসার পরও জিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা- এ নিয়ে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। আমি মনে করি জিয়া হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার হলে বিএনপি নামক দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। 


এবার খন্দকার মোশতাকের পতন প্রসঙ্গে আসি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের ঘনিষ্ঠতা ৪০-এর দশক থেকে। কিন্তু ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলে দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন বঙ্গবন্ধু এবং দ্বিতীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন খন্দকার মোশতাক। ব্যক্তিগত জীবনে মোশতাক ছিলেন অতিশয় দাম্ভিক, অহংকারী এবং উচ্চাভিলাষী। তিনি পীর বংশের লোক এবং কর্মজীবনে প্রথিতযশা আইনজীবী হওয়ার কারণে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অধিকতর যোগ্য মনে করতেন। কিন্তু গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদর্ীর আপাত্য স্নেহ এবং দলের তরুণ নেতাকমর্ীদের কাছে প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল খন্দকার মোশতাকের তুলনায় অনেক অনেক দৃঢ়। যা হোক সেই ১৯৫৩ সাল থেকেই মোশতাক বঙ্গবন্ধুর পেছনে লেগে ছিলেন। সর্বদা প্রিয় বন্ধুর ছদ্মাবরণে নিজেকে ঢেকে রাখলেও বঙ্গবন্ধুর পতনের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন অনবরত। একথা এখন সবাই জানে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অংশ, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের প্রভাবাধীন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর একটি অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ছিল। চক্রান্তে জড়িত ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনও। খন্দকার মোশতাক যখন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের আমন্ত্রণ জানালেন সেদিন হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই হুড়হুড়িয়ে বঙ্গভবনে হাজির হয়েছিলেন। যাহোক মোশতাকের প্রেরণাদাতারা কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন যে, তারা একটি জঘন্যতম কাপুরুষ এবং অপদার্থকে প্রমোট করেছেন। তিনি যখন ক্ষমতার শীর্ষে সেই অবস্থাতেও বঙ্গভবনে একাধিকবার ক্যাপ্টেন ও মেজর পদমর্যাদার সামরিক অফিসারদের পা জড়িয়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। কর্নেল ফারুক, রশিদ, ডালিম গংকে তিনি আজরাইলের মতো ভয় পেতেন। এরই মধ্যে ঘটে গেল মর্মান্তিক জেলহত্যা এবং তৎপরবতর্ী ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতা বিপ্লব। খন্দকার মোশতাকের এদেশীয় গোপন সহযোগীরা আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। পরে জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় প্রাণে বেঁচে যান মোশতাক কিন্তু ক্ষমতাচু্যত হন তারই দীর্ঘদিনের চক্রান্তের অংশীদারদের জন্য। 


১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এই পরিসরে আলোচনা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু যাদের বিশ্বাস করতেন এবং যাদের পরামর্শ মতো চলতেন সেই মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর গংই তাকে হত্যা করেছে। এখানেও ইতিহাসের সেই বাণী- তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে, কিংবা ঘরের শত্রু বিভীষণ। 


আমি নিজে নিজে ভাবি কেন অমন হয়! এর অন্যতম কারণ হল ক্ষমতায় যাওয়ার পর মানুষ সীমাহীন আনুগত্য পছন্দ করতে থাকে। অন্যদিকে সুবিধাবাদীরা কর্তার ইচ্ছায় এমনভাবে নিজেদের ক্ষমতার সামনে উৎসর্গ করে যাতে করে ক্ষমতাসীনরা বাস্তব থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। অনেকের মধ্যে এক ধরনের রোগের সৃষ্টি হয় যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় হিলোসিনোজেন। এই রোগ হলে মানুষ শত্রুকে আপন মনে করে এবং আপনকে শত্রু মনে করে থাকে। আশপাশের লোকজন প্রতিনিয়ত এবং অনবরত তেলবাজি করলে এবং কানকথা শোনার অভ্যাস থাকলে এই রোগ এমনিতেই হয়ে যায়। আবার অনেক সময় ওষুধ খাইয়েও এই রোগ সৃষ্টি করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল হিটলারকে এই জাতীয় ওষুধ খাওয়ানোর জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু হিটলারের আশপাশে এমন কোন বিশ্বাসঘাতককে সেদিন ব্রিটিশ তথা মিত্রবাহিনীর গোয়েন্দারা খুঁজে পায়নি যার মাধ্যমে হিটলারকে ওই ওষুধ খাওয়ানো যেত। ফলে প্রকল্পটি সেই সময় ব্যর্থ হলেও নানা দেশে নানা সময়ে ওষুধটি সার্থকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর তাদেরই তথাকথিত বিশ্বস্ত পাত্রমিত্রদের মাধ্যমে। 

লেখক : গোলাম মাওলা রনি, সংসদ সদস্য
প্রকাশ : ২৭শে আগষ্ট ২০১২, যুগান্তর

2 comments: