কেনো আমি মনোনয়ন পত্র কিনলাম না!

গোলাম মাওলা রনি: আমার এলাকায় কয়েক লাখ লোক, দেশ বিদেশের শত সহস্র বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীর একই প্রশ্ন- আমি কেনো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পত্র কিনলাম না। নানা জনের নানা মত, নানা উপদেশ আর কারো কারো বিভিন্ন আশংকামূলক সতর্কবার্তা-এ সব নিয়ে আমার দিনকাল যেনো কেমন কেমন ভাবে দুলতে দুলতে পার হয়ে যাচ্ছে।

৫০ দিন জেল খাটার পর- নিজের বিশ্বাস, ভালবাসা আর নির্ভরতার জায়গায় প্রচন্ড একটি হোচট খেয়েছি। নিতান্ত নির্বোধ হবার পরও বুঝতে কষ্ট হয়নি- যার মুকুট মাথায় নিয়ে ঘোরাফেরা করতাম, তিনি তার সেই স্বীকৃতি ফেরত নিয়ে গেছেন জেলে ঢোকানোর মধ্য দিয়ে। ফলে জেল থেকে বের হবার পর সংসদে যায় নি। কারণ, আমার মনে হয়েছে ওখানে যাবার নৈতিক অধিকারের যে কেন্দ্র তা থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে কোন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই।

দলটির সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক সেই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। আর আমার সম্পর্ক শৈশব থেকে। যে আদর্শের কথা আমরা গর্ব ভরে প্রচার করি মনে প্রাণে সেই আদর্শ ধারণ করে কথাবার্তা, চালচলন ও বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আসছিলাম। এখন মনে হচ্ছে প্রচারের বিষয় কখনো শতভাগ অনুসরণ করতে নেই।

দীর্ঘদিন বাজারে জোর গুজব ছিলো যে, আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না। আমি বিশ্বাস করিনি। এমন কি জেলে যাবার পরও। কিন্তু জেল থেকে বের হবার পর দেখলাম অন্য এক দুনিয়া- দলের কেউই আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এমনকি আমার স্ত্রী উপযাচক হয়ে অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা পর্যন্ত বলতে পারে নি। এক নাগারে পনের দিন চেষ্টা করেও গণভবনে ঢুকতে পারে নি। এই অবস্থায় ধরে নেয়াই স্বাভাবিক- আমাকে খরচের খাতায় ফেলে দেয়া হয়েছে।

বৃন্ত থেকে বিচ্যুত হওয়া ফুলই বুঝতে পারে তার কষ্ট। সেই কষ্টের সঙ্গে যদি নতুন অপমান জোটে তা আমি বা আমার পরিবার বা শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষে বহন করা কষ্টকর হবে। অর্থ্যাৎ আমাকে মনোনয়ন দেয়া হবে না- এই ইঙ্গিতটি স্পষ্ট হয়েছে জেল থেকে বের হবার পর। তাই বেদনার পরিমান না বাড়িয়ে আত্ম মর্যাদা রক্ষার্থে নিরাপদ দূরে থাকাই বোধ হয় শ্রেয় হবে- এই ধারনার বশবর্তী হয়ে মনোনয়ন ফর্ম কিনলাম না।

অনেকে বলবেন- আপনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি বা আপনি কি আদৌ নির্বাচন করবেন কি না? আমার বক্তব্য হচ্ছে- সামনের দিনগুলোই বলে দিবে আমার অবস্থান। কারণ- সময়, সুযোগ এবং আল্লার ইচ্ছা ব্যতিত কোন সফলতা মানুষের হাতে ধরা দেয় না। সেরকম কিছু হলে আমি অবশ্যই স্বতন্ত্র নির্বাচন করবো ইনশাআল্লাহ।

জয় বা পরাজয় নিয়ে আমি আদৌ চিন্তিত নেই। জয়ের ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। আবার পরাজয় নিয়েও কোন মাথা ব্যাথা নেই। শতভাগ জয়ের স্বপ্ন দেখে কেবল কল্পনা বিলাসী কাপুরুষরা। জীবনের কোন কোন জয় যেমন পতন ডেকে নিয়ে আসে তেমনি কোন কোন পরাজয় অমিত জয়ের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে দেয়- আমার জন্য কোনটি হবে তা আমি জানি না। জানতেও চাইনা। আমার কাজ কর্তব্য সম্পাদন করা। সফলতা বা ব্যর্থতা দেবার মালিক আল্লাহ। আল্লার কর্মটি বান্দারা যখন করতে চায় তখন আসমানের গজবের দরজাগুলো আপনা আপনি খুলে যায়- এই নির্মম সত্য আমাকে অনেক কিছু করা থেকেই বিরত রাখে।

আমি মনে করি দল হিসেবে এখনো আওয়ামী লীগই শ্রেষ্ঠ। সারা বাংলাদেশের কোটি কোটি নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকার মজাটাই আলাদা। আমি সেই আনন্দ থেকে নিজেকে পারতপক্ষে বঞ্চিত করবো না। আওয়ামী লীগের এই মুহুর্তের সবচেয়ে বড় সমস্যা কতিপয় অপরিপক্ক, বিশ্রী চরিত্রের এবং যাদের দেখলে বা কথা শুনলে মানুষের বমি বমি ভাব আসে কিংবা সারা শরীর চুলকানীর উদ্রেক হয় এমন সব মানুষ- যারা যোগ্যতার পরিবর্তে দালালী করে স্ব-স্ব স্থানে বসেছে এবং দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

ঐ সব লোকের কারণে আমি যদি দল থেকে দূরে চলে যাই তবে বঙ্গবন্ধুর আত্মা কষ্ট পাবে। আমার বিশ্বাস আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দূর্গন্ধ ছড়ানো নেতারা কোথায় যে যাবে তা নয়ে গবেষণার দরকার হবে। যদি যেনো তেনো নির্বাচন হয় তবেও তারা পাশ করবে না। আর তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা মাঠেই যাবে না। আল্লাহ না করুন আরো কড়া বা কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে- তারা শুরু করবে দৌড়! সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারপর চিন্তা করবে কেনো আসলাম, কোথায় আসলাম। কেউ কেউ হয়ত ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় স্বস্তিত হারাবে, কেউবা কাঁদবে- আর পথচারীরা দয়া পরবশ হয়ে তাদেরকে খাদ্য- পানীয় বা বস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে- যদি তখন তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে পারে।

সময়ের সাহসী সন্তানেরা সব সময় দলটির জন্য ত্যাগ করেছে- বারে বারে তারা ফিরে গেছে আপন কুঠুরিতে কেবল ত্যাগের জন্য। ভোগের জন্য নয়। এমনটিই হয়ে আসছে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে আজ অবধি। আগামী দিনেও তাই হবে- যা হয়েছিলো অতীতে। সেই ত্যাগের সংগ্রামে একজন কর্মী হিসেবে পদচিহ্ন রাখার প্রত্যয় নিয়েই প্রার্থনা করছি -হে আল্লাহ! ভোগীদের জন্য তোমার ক্রোধ যেনো ত্যাগীদের প্রতি নিপতিত না হয়। ত্যাগীদের রক্ত, জীবন আর ধন-সম্পদের সর্বনাশ যেনো ভোগীদের অপকর্মের কাফফারা না হয়।
সূত্র: ফেসবুক স্ট্যাটাস

পরকীয়া নয় আপনকীয়া

পরকীয়া নিয়ে কিছু একটা লিখব- এ কথা শুনেই এক পরিচিত লোক বললেন- পরকীয়া বলছেন কেন। ওটা তো আপনকীয়া। এক ঘরের নিচে বাস করলেও স্বামী-স্ত্রী যেন একে অপরের থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সমস্যাও আছে বটে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং ব্যক্তির মন-মানসিকতাও অনেকাংশে দায়ী পরকীয়া নামক এ ব্যাধির জন্য। আমি প্রথমে নিজের কিছু ঘটনা বলি- প্রায় ২৬ বছর হতে চলল আমার বিয়ের বয়স। প্রথম কয়েক মাস বেশ রং-রসের মধ্যেই কাটল। এরপর রূঢ় বাস্তবতা, অর্থকষ্ট। তারপর ছেলে সন্তানের জন্ম এবং তাদের মানুষ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা। স্ত্রীর দিকে তাকাতেই ফুরসত পাইনি, অন্যদিকে তাকানো তো দূরের কথা। অথবা সুযোগই পাইনি বা আসেনি। আসলে কী হতো তা জানি না, এরই মধ্যে সিকি শতাব্দীর দাম্পত্য জীবনে আমরা একে অপরের মন্দগুলোই যেন ভালোবাসার পুষ্পমাল্য বানিয়ে নিয়েছি। যেমন আমার ভীষণ অপছন্দ নাক ডাকা। ইদানীং লক্ষ্য করলাম তিনি নাক ডাকছেন। অভিযোগ করতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার অবস্থা। উল্টো অভিযোগ, আমি নাকি নাক ডাকি এবং তা ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দকেও ফেল করে। কি আর করা। কখনো ঘুম ভেঙে গেলে ওই শব্দ শুনে পছন্দের রবীন্দ্রসংগীত মনে করে ছন্দ মেলাতে শুরু করলাম। চিৎ হয়ে শুয়ে নিজের পেটটাকে তবলা বানিয়ে ছন্দে অতিরিক্ত লালিত্য মেশানোর চেষ্টা করলাম। ওষুধের মতো কাজ দিল। এখন অভ্যাস এমন হয়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে ওই ছন্দময় গীতসংগীত শ্রবণের জন্যই হয়তো বা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।

যা বলছিলাম; পরকীয়া। পরিচিতজনদের কাছে এসব কথা শুনি। খুবই রগরগে। আমার মতো নিরামিষভোজীও উত্তেজিত হয়ে উঠি। ভয়ঙ্কর সব লালসার গল্প। নিজে যেরূপ অন্যায়ের পথে সমর্পিত হচ্ছে, তদ্রূপ ইচ্ছা করেই স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূদের অনৈতিক কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। মদ, জুয়া ও অশালীনতার শত সহস্র আসর ঢাকার অভিজাত পল্লীগুলোতে জমজমাট হয়ে ওঠে; বিশেষত সন্ধ্যার পর। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের মানসিকতা। কোনো মানুষ যে পরকীয়া দোষে দোষী নয়- এ কথা আর বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার দুটি লেখা ছাপা হওয়ার পর আমি এত টেলিফোন এবং প্রতিক্রিয়া পেলাম যে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। প্রথম লেখাটি ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা, অন্তরালে যৌনতা এবং দিনান্তের পতন। মূলত এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক লেখা। রাজা-বাদশাদের অনৈতিক, প্রেম ও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কয়েকটি উপাখ্যান। অনেক রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী ফোন করে তাদের স্বামীদের অপকর্মের কথা বলল, এমনকি নামধাম প্রকাশ করে আমাকে তাদের দুঃখের কাহিনী প্রকাশ করতে বলল। কয়েকজন ফোন করে দেখা করতে চাইল। নিজেদের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের রক্ষিতা বলে পরিচয় দিল এবং তাদের কাহিনীগুলো আমাকে জানাতে চাইল।

অন্য একটি লেখা ছিল- 'শাওনের কান্না, মিলি ভাবী এবং আমার প্রেম'। এটাও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। বন্ধুবর সম্পাদক নঈম নিজামের প্রতি ভীষণ রাগ হলো। কারণ শিরোনামটি তারই দেওয়া- আমারটি ছিল অন্যরকম। যারা পড়ল তারা বিভিন্নভাবে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল। যারা শুধু শিরোনাম পড়ল তারা আমাকে সরাসরি চরিত্রহীন ভাবল। অনেকে আবার অন্যের মুখে শুনে আমাকে বাঁকা হাসি দিয়ে প্রশ্ন করল, আমি প্রমাদ গুনলাম স্ত্রী মহোদয়াকে নিয়ে। ঢাকার বাইরে ছিলাম। এসে বুঝলাম সে পড়েনি। শাওন মানে লেখক হুমায়ূন আহমেদের বিধবা স্ত্রী। কোনোদিন কথাও হয়নি কিংবা চাক্ষুষ দেখিনি। তার মা আমাদের সহকর্মী। সবাই অভিযোগ করছে, শাওন কেবল অর্থলোভেই হুমায়ূনকে বিয়ে করেছে। আমার মনে হলো, এটা ঠিক নয়। সে সত্যি অর্থেই হুমায়ূনের মেধা ও লেখক প্রতিভাকে ভালোবেসেছে। তার বয়সে সে স্বাভাবিকভাবেই সুদর্শন কোনো যুবককে ভালোবাসবে। অন্যদিকে অর্থের জন্য ভালোবাসার তো প্রশ্নই আসে না। যে কারণে মানুষের অর্থলোভ হয় সেটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সে ধনীর মেয়ে এবং হুমায়ূন আহমেদের বিত্ত-বৈভবের তুলনায় তার পৈতৃক ধনসম্পত্তি অনেক বেশি। অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারকে নিয়ে যে সন্দেহ অনেকে করছে তাও আমার কাছে বিকৃত রুচির মানসিকতাই মনে হয়েছে। যে মানুষটি অসুস্থ হুমায়ূনের শিয়রে ছিলেন বছরের পর বছর। ব্যয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। ব্যবসা, বাণিজ্য, অফিস ছেড়ে যেভাবে তিনি হুমায়ূন আহমেদের পাশে থেকেছেন- সেই দৃষ্টান্ত আমি নিকট বর্তমানে দেখিওনি কিংবা শুনিওনি। কাজেই মানবিকতাবোধ থেকেই তাদের পক্ষে লিখেছি। কিন্তু সমাজের বিকৃত মানুষেরা সরাসরি আমাকেই আক্রমণ করে বসল। কেউ বলল- আপনি কে? আপনার লেখার কী দরকার ছিল! আপনার তো একটি ইমেজ রয়েছে। কেন এসব ফালতু বিষয় নিয়ে লিখতে গেলেন ইত্যাদি। অদ্ভুত একটি এসএমএস পেলাম অজানা জায়গা থেকে। সে লিখেছে- 'তোর গায়ের রং যেমনি কালো, তেমনি তোর অন্তরটা আরও কালো। তাই কালিয়ার খোঁজে নেমেছিস।'

অদ্ভুত এই বিচিত্র সেলুকাসের দেশে মানুষের মন যে কিরূপ বিকৃত হয়ে পড়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করলাম এবং পরকীয়ার মনস্তাত্তি্বক কিছু বিষয় বোঝার চেষ্টা করলাম। ইচ্ছা ছিল খুশবন্ত সিংয়ের মতো নিজের জবানিতে লিখব। কিন্তু সম্মানিত পাঠকদের কথা ভেবে সাহসী হলাম না। একটি কল্পিত চরিত্রের মাধ্যমে আমার দেখা সমাজের কিছু দৃশ্যের কথা আপনাদের বলছি- জয়নাল সাহেব এখন বেশ সচ্ছল। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। ব্যবসা করেন। লোকজন তাকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানে। সত্তরের দশকে প্রথম সিনেমা দেখেন রূপবান। নায়িকা সুজাতাকে তার খুবই পছন্দ হয়। সিনেমাটিতে রূপবানের বয়স ১২ বছর আর নায়কের বয়স ১২ দিন। জয়নাল সাহেবের সেই থেকেই চিন্তা- ১২ দিনের ছেলে রহিমের যদি বিয়ে হতে পারে, তবে ১৪ বছরের জয়নালের কেন নয়। সে সিনেমাটি কয়েকবার দেখল। গানগুলো সব মুখস্থ হয়ে গেল। তার নায়িকা রূপবানকেও ভালো লাগল, আবার ভিলেন নায়িকা তাজেলকেও ভালো লাগল। তার প্রশ্ন জাগল, দুটি বউ থাকলে কি এমন হয়! তার দাদার তো চারটা বউ রয়েছে। যেই কথা সেই কাজ- ১৪ বছরের কিশোর জয়নাল হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজতে লাগল। খুঁজতে লাগল মানে প্রেম করার সুযোগ খুঁজতে লাগল। সময়টা সত্তরের দশক। সমাজ অনেকটা কনজারভেটিভ। মেয়েরা আরও বেশি। জয়নাল সাহেব যত বেশি বেশি মেয়েদের দিকে তাকায় তারা ততই বিরক্ত হয়। কয়েকটি মেয়ে তাদের অভিভাবকের কাছে নালিশ করল। কেউ কেউ স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করল। জয়নালকে শিক্ষকরা বেশ মারল। মার খেয়ে তার প্রেমাকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে গেল। বিশেষত হিন্দু মেয়েদের প্রতি তার মোহ ছিল বেশি। কেন জানি হিন্দু মেয়েদের তার খুব রূপসী মনে হতো। আর প্রায় সব হিন্দু মেয়েই গান জানে। জয়নাল সাহেব আবার শৈশব থেকেই ছিলেন সংগীতপ্রিয়।

কথায় আছে- মানুষ যা আকাঙ্ক্ষা করে এবং চেষ্টা করে, ফলাফল সেরকমই হয়। জয়নাল সাহেব বিয়ে করে ফেললেন অল্প বয়সেই। প্রথম কয়েক মাস খুব রং-রসের মধ্যে গেল। স্ত্রী সুন্দরী, অনুগতা এবং পতিব্রতা। বেশ ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধাল রূপবান সিনেমার কাহিনী। জয়নাল সাহেবের বার বার মনে হচ্ছিল, খল নায়িকা তাজেলের কথা। তার মনে হলো তাজেলের মতো আরেকটা মেয়ে পেলে মন্দ হতো না। চুপি চুপি কিছুদিন প্রেম করবে। তারপর একদিন বিয়ে করবে। দুই বউ। বেশ মজাই হবে। জয়নাল সাহেব মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত। কল্পিত তাজেলকে সে পাশে বসায়, খাইয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে খুনসুঁটিও করে। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময়। স্ত্রী বকা দেয়- কেন সে শুয়ে শুয়ে একা একা বিড় বিড় করে! জয়নাল সাহেবের পরিবার বেশ ধর্মপরায়ণ। জয়নাল সাহেবও তদ্রূপ। বিয়ের কিছুদিন পরই সে দাড়ি রাখা শুরু করল।

তাজেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য জয়নাল সাহেব উঠেপড়ে লাগল। সময় পেলেই বিভিন্ন মার্কেটে যায়। সেখানে অনেক মেয়ে দেখে কিন্তু পছন্দ হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজের সামনেও অনেক ঘুরল। এবার অনেককে পছন্দ হলো। কিন্তু কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রেম করবে তা ভেবে পেল না। নিজের ক্লিন ইমেজের জন্য বিষয়টি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারছে না। পরিকল্পনা করতে হচ্ছে নিজে নিজেই। সে ভাবল টেলিফোনে রং নাম্বারে ফোন করে হয়তো কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে। যেই কথা সেই কাজ। প্রতিদিন বিকালে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে সে গুলশান, বনানী ও ধানমণ্ডির ফোন নম্বরগুলোতে চেষ্টা করতে থাকল। এবার সে প্রতিজ্ঞা করল- যেহেতু রিস্ক নিয়ে প্রেম করবে সেহেতু প্রেমিকাকে হতে হবে ধনীর কন্যা, সুন্দরী এবং কিছুটা দেমাগী- অনেকটা তাজেলের মতো। চেষ্টা চলল। কিন্তু সহসা কিছু হলো না। জয়নাল সাহেব হাল ছাড়লেন না। এরই মধ্যে ধানমণ্ডির একটি নম্বরে কাঙ্ক্ষিত কাউকে পেয়ে গেলেন। কিশোরী মেয়ে। সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। জয়নাল সাহেবের তুলনায় ১২ বছরের ছোট। জয়নাল সাহেব নিজের বয়স কমিয়ে বললেন। মজার মজার কথা এবং নিজের পরিণত বয়সের চাতুরীমূলক অভিজ্ঞতার অভিনব বর্ণনে তিনি মেয়েটাকে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেললেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে প্রেমালাপ। এভাবে চলল প্রায় ১৫ দিন। মেয়েটির সুললিত কণ্ঠ এবং বংশ-পরিচয় তার খুবই পছন্দ হলো। টেলিফোনে উচ্চতা, গায়ের রং, চুলের স্টাইল, আত্দীয়স্বজন এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণ নিলেন। সবই পছন্দের। এবার চর্মচক্ষে দেখার পালা। কিশোরীও পাগলপ্রায়। জয়নাল সাহেব চিন্তা করেন কীভাবে মেয়েটাকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করা যায়। আইনগত বাধা ছিল না, কারণ তখনো বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ নিরোধ আইনটি হয়নি। বাধা শুধু সামাজিক। জয়নাল সাহেব ভাবলেন- পালিয়ে কোথাও চলে গেলে এবং বিয়ে-থা হয়ে গেলে বোধহয় তেমন সমস্যা হবে না। উভয়ের সম্মতিতে দেখা-সাক্ষাতে দিনক্ষণ ঠিক হলো। মেয়েটি এলো। জয়নাল সাহেবও গেলেন। কিন্তু একে অপরকে দেখার পর উভয়েই হতাশ হলেন। মেয়েটি জয়নাল সাহেবের বয়স, উচ্চতা এবং দাড়ি দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো। জয়নাল সাহেবের আত্দসম্মানে ভীষণ লাগল। অন্যদিকে জয়নাল সাহেব যেমনটি আশা করেছিলেন মেয়েটি তেমন সুন্দরী ছিল না। বিশেষত তার উপরের পাটির দাঁত একটু উঁচু থাকায় বার বার শুধু নিজের রূপবানের কথাই মনে পড়ছিল। আলোচনা জমল না, ঘণ্টাখানেক ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে এলোমেলো ঘোরাফেরা করে তারা যে যার স্থানে ফিরে এলো। এরপর কয়েকদিন টেলিফোনে হালকা কথাবার্তা হলো। কিন্তু জমল না। জয়নাল সাহেব রাগের চোটে দাড়ি কামিয়ে ফেললেন। লোকজন জিজ্ঞাসা করল হায়! হায়! এটা কী করলে। জয়নাল সাহেব বললেন- দেশের অবস্থা ভালো না। দাড়িওয়ালা যুবকদের দেখলেই লোকজন ছাত্রশিবিরের কর্মী মনে করে- তাই দাড়ি কামিয়ে ফেললাম। তাজেলের খোঁজে জয়নাল সাহেব যখন প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন তখন রূপবানের ঘরে দুটি সন্তান জন্ম নিল। বিবাহিত জীবনেরও প্রায় ১৪-১৫ বছর হতে চলল। ইতোমধ্যে রূপবানরূপী স্ত্রীর রূপেও কিছুটা ভাটা পড়েছে। সাংসারিক কাজে প্রায়ই খটর-মটর লাগে। স্ত্রী ঝগড়া শুরু করল। মাঝেমধ্যে গালিও দেয়। আর ঝগড়া লাগলে স্ত্রী গ্রাম্যভাষায় তুই-তুকারি শব্দ ব্যবহার করে। ধর্মভীরু জয়নাল সাহেব নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকল- হায় আল্লাহ, এই ডাইনিটা যেন মারা যায়। এভাবেই চলছিল। কিন্তু এর মধ্যে সে জানল যে, কারও জন্য মৃত্যু কামনা করলে নাকি তার আয়ু বাড়ে। সে ভয় পেয়ে গেল। এখন কি হবে। সে কি স্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করবে। স্ত্রীর দীর্ঘায়ু চেয়ে মোনাজাত করার চেষ্টা করল। কিন্তু মন সায় দেয় না। সিদ্ধান্ত নিল, এ ব্যাপারে সে আল্লাহকে কিছুই বলবে না। যাই হোক সে ঘরে সময় কম দেওয়া শুরু করল এবং তাজেল খোঁজার কাজ পুনরায় আরম্ভ করল। ইতোমধ্যে জয়নাল সাহেব ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ প্রসার লাভ করেছেন। ব্যবসায়ী সমাজে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনেক ধনাঢ্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার সখ্যও গড়ে উঠেছে। বিদেশেও যাওয়া পড়ছে ঘন ঘন। অনেক পরিচিতজনের জীবনই দেখলেন অশ্লীলতায় পূর্ণ। তারা বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে অবৈধ প্রণয় করছে। শারীরিক মেলামেশা করছে। অনেকে এই প্রণয়কর্মের জন্য আলাদা বাড়ি কিংবা বাগানবাড়িও নির্মাণ করেছে। অনেকে আবার পাঁচতারা হোটেলগুলোকে ব্যবহার করছে দিনে কিংবা রাতে। পুরুষদের প্রণয়ের সঙ্গী হচ্ছে বিবাহিত মহিলারা, বিশেষত ধনাঢ্য পরিবারের মহিলারা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণীও শয্যাসঙ্গী হচ্ছে- তবে অর্থের বিনিময়ে। এর বাইরে হাই সোসাইটির কলগার্লদের সঙ্গেও কিছু পরিচিত ব্যবসায়ীর নিয়মিত যোগাযোগ তার দৃষ্টিগোচরে এলো। কিছু রসিক ব্যবসায়ী আবার দেশ-বিদেশের পরিচিত নায়িকা বা মডেল কন্যাদের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরমের রসালো গল্প জয়নাল সাহেবের কাছে বলল। কিন্তু এসব কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করল না। সম্ভবত আজন্ম কঠিন পারিবারিক শিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতাবোধ তাকে অবাধ যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহী করল না। বন্ধুরা তাকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করল। কেউ কেউ নিজেদের বান্ধবীদের উপহার প্রদানের কথা বলল। কেউ কেউ আবার বলল- যাও পারলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম কর, কিছু বলব না। জয়নাল সাহেব মনে মনে 'লা হাওলা' পড়েন। এসব অশ্লীল মানুষকে এড়িয়ে চলা আরম্ভ করলেন। ফলে বেশ কিছু দিন তার মন ভারি হয়ে রইল। এদিকে জয়নাল সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তেই থাকল। নিজের বংশ-আভিজাত্য ধর্মবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষার কারণে তিনি চাইলেন স্ত্রীর সঙ্গে একটি মোহময় ও প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে তোলার। কিন্তু স্ত্রী যেন কেমন। সবকিছুতেই তার একটা গেঁয়ো ভাব। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে প্রেম-রোমান্টিকতা যে থাকতে পারে তা ভদ্রলোকের স্ত্রী বুঝতেই চান না। রান্না-বাড়া, ঘরের কাজ, সন্তান-সন্ততি দেখাশোনা করা এবং কালেভদ্রে স্বামীর শয্যাসঙ্গী হওয়াকেই তিনি তার দায়িত্ব মনে করেন। অন্যদিকে জয়নাল সাহেব চান স্ত্রীর সঙ্গে সব বিষয় শেয়ার করতে। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, ভালোলাগা সবকিছুই স্ত্রীকে বলতে চান। কিন্তু এতে স্ত্রী ভীষণ বিরক্ত হন। জয়নাল সাহেব যদি দীর্ঘক্ষণ নামাজ পড়েন কিংবা বই পড়েন বা গান শোনেন- সব কিছুতেই স্ত্রীর আপত্তি। স্ত্রী চান জয়নাল সাহেব যেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন। সকাল-বিকাল পালা করে তাদের পড়ান। স্কুলে নিয়ে যান। ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেন। বাজারঘাট নিয়মিত করেন ইত্যাদি। জয়নাল সাহেবের বক্তব্য, ওইগুলো তো টাকা দিয়েই করা যায়। ঘরের কাজ বুয়ারা করবে। রান্নার কাজ বাবুর্চি করবে। ছেলেমেয়েদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখা হবে। নাহ, তা হবে না- স্ত্রীর সাফ জবাব। জয়নাল সাহেব অনেক কষ্ট করে গ্রাম থেকে কাজের ছেলে বা মেয়ে আনেন। আর স্ত্রী মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে গ্রামে জয়নাল সাহেবের স্ত্রীর বদমেজাজের বেশ সুখ্যাতি হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে আর কাউকে আনা যাচ্ছে না। ফলে ভদ্র মহিলাকে সব কাজ একাকীই করতে হয়। এ নিয়ে জয়নাল সাহেবের স্ত্রীর প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। বরং প্রচণ্ড রাগ হয়। কাজের লোকদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি তিনি একদম পছন্দ করেন না। আর স্ত্রীর এ ধরনের গৃহকর্মে মনোনিবেশও তার অপছন্দ। তিনি চান স্ত্রী তার অফিসে মাঝেমধ্যে আসুক। সামাজিক জীবনের সঙ্গিনী হোক এবং অবসরে তার সঙ্গে প্রেম করুক। কিন্তু স্ত্রীর ভালোবাসা যেন গৃহকোণে বন্দী থাকার মধ্যে এবং সারা দিনের কর্মশেষে যখন জয়নাল সাহেব বাসায় ফেরেন তখন তার সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য নিত্যনতুন পরিকল্পনা প্রণয়নের মধ্যে। ফলে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে জয়নাল সাহেবের মনও তাজেলের খোঁজে পুনরায় অস্থির হায় ওঠে। মনের মতো আরেকটা বউ পাওয়ার জন্য জয়নাল সাহেবের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার রোমান্টিক মন। সে বিয়ে করার আগে বউয়ের রোমান্টিকতা যাচাই করতে চায়। এ জন্য দরকার প্রেম করা। অন্যদিকে বর্তমান স্ত্রী বা সন্তানদের প্রতি দায়িত্ববোধও তাকে তাড়িত করে। স্ত্রী ও সন্তানদের সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। স্ত্রীকে মনের মতো করে না পাওয়ার বেদনা থেকেই সে বিকল্প কিছু একটা খুঁজছে। খোঁজাটা আবার যেনতেন নয়। সে চাচ্ছে তার হবু দ্বিতীয় স্ত্রী রূপ-গুণ-বংশ মর্যাদায় তার প্রথম স্ত্রীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ হোক। বর্তমান স্ত্রী প্রায়ই তাকে খোটা দেয়- আমার মতো স্ত্রী আর পাবে না। মরলে দেখো, আরও একটা বিয়ে করে দেখো, তোমার যে অভ্যাস- আমি বলে ঘর করে গেলাম। অন্য মহিলা হলে একদিনও তোমার সঙ্গে থাকতে পারবে না ইত্যাদি। জয়নাল সাহেব উত্তর দেন না। কিন্তু মনে মনে জিদ ধরেন- যা থাকে ভাগ্যে! কিছু একটা এবার করে দেখাতেই হয়। এদিকে বয়স বেড়ে যাচ্ছে। চুলেও পাক ধরেছে। এ অবস্থায় কী করে আরেকটি বিয়ে করা যায়। বিষয়টা নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে সে খোলামেলা আলোচনা করলেন। বন্ধু বললেন- আরে বোকা, যারা দ্বিতীয় বিয়ে করে তারা কখনো প্রথম স্ত্রী নিয়ে এত ভাবে না। হঠাৎ করে ফেলে। কিন্তু কীভাবে? বন্ধু বলে বিয়ের কথা গোপন রেখে কারও সঙ্গে প্রেম কর, অথবা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বল যে, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না ইত্যাদি ইত্যাদি। সবই তো বুঝলাম- বলেন জয়নাল সাহেব। কিন্তু যাব কোথায়? তাকে পাব কোথায়? একবার সিদ্ধান্ত নেয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন। কিন্তু সাহস হয় না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেন, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈকালিক সেশনে এমবিএ-তে ভর্তি হবেন। উদ্দেশ্য সেখানে হয়তো কোনো সুন্দরী এবং যোগ্য মেয়েকে পাওয়া যেতে পারে। হোক না বিধবা, কিংবা তালাকপ্রাপ্ত। দু'একটি সন্তান থাকলেও আপত্তি নেই। আগে কুমারী বা অবিবাহিত কাউকে কল্পনা করা যেত। এখন আর সম্ভব নয়। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। একটি স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। খরচ পড়ল প্রায় ৫০ হাজার টাকা। প্রথম দিন ক্লাসে যাওয়ার আগে উত্তেজনায় ঘুমাতে পারলেন না। না জানি কতজন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা দেখতেই বা কেমন হবে। তার সঙ্গে প্রেম করবে তো। ইত্যাদি চিন্তা করতে করতে নির্ঘুম রাত অবশেষে পোহাল। সারাদিন গেল উত্তেজনায়। অবশেষে বিকালে ক্লাসে গেলেন জয়নাল সাহেব। ওরে বাবা, একি! প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ে মাত্র চার-পাঁচজন। তাও আবার একে অপরের চেয়ে কুৎসিত। এর মধ্যে সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটি জয়নাল সাহেবের পাশে বসল। একেবারে গাঘেঁষে। বয়সও তো মনে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছিল। জয়নাল সাহেব তাকাতে ভয় পাচ্ছিলেন। মেয়েটিই উদ্যোগী হয়ে কথা বলল। মুখ থেকে দুর্গন্ধের ঝাপটা জয়নাল সাহেবকে আক্রমণ করল। তিনি ওয়াশ রুমে যাওয়ার কথা বলে ক্লাসরুম ছাড়লেন। আর কোনোদিন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়েও হাঁটেননি।

জয়নাল সাহেবের ক্লান্ত এই প্রেমযাত্রায় সত্যিই এবার ফুল ফুটল। এক ভদ্র মহিলার সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় হলো। বেশ সুন্দরী ও লম্বা। গায়ের রং দুধে আলতা। ঠিক যেমনটি তিনি কল্পনা করতেন। বংশও ভালো। ব্যবসা করেন। বোরকা পরেন, কিন্তু নিচে জিন্স প্যান্টও পরেন। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করেন। নামাজ-কালাম, কোরআন পড়া, নফল ইবাদত-বন্দেগি, রোজা রাখার মতো ধর্মীয় গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক গানের গলাও বেশ দরাজ। বিবাহিত। বয়স ২৮-২৯ বছর হবে। দুটো সন্তান রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। ধর্মভীরু জয়নাল সাহেব মনে করলেন, এবার বোধহয় আল্লাহপাক তার প্রতি রহম করেছেন। আলাপ জমে উঠল- ফোনে ফোনে। কারণ দেখা হয়েছে মাত্র একবার এবং তিনি পর্দার কারণে দেখা-সাক্ষাতে আগ্রহী নন। প্রেয়সীর বয়স যেহেতু কম, সেহেতু জয়নাল সাহেবকেও শারীরিকভাবে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তিনি নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করলেন। ডাক্তারের কথামতো সন্ধ্যা ৮টার মধ্যে খাবার খান। এরপর হাঁটতে বের হন। টানা দেড় ঘণ্টা হাঁটেন ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে। হাঁটতে হাঁটতে যখন জাহাজ মার্কা বাড়ির সামনে দাঁড়ান তখন সেখানে প্রেমরত তরুণ-তরুণীদের দিকে আড় চোখে তাকান। বেশ জড়াজড়ি করে তারা বসে থাকে। কী করে অন্ধকারে তা স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যায় আপত্তিকর কিছু একটা করছে। আগে খুব রাগ হতো এ ধরনের দৃশ্য দেখলে। মনে হতো একটি লাথি দিয়ে ওদের তাড়িয়ে দেন। কিন্তু এখন হয় না। বরং এক ধরনের মায়া লাগে। আহারে! বেচারারা কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। সে মনে মনে ভাবে বিয়ের পর নববধূকে নিয়ে প্রায়ই সে ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে বসবে। বিশেষত জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে। বাদাম কিংবা পপকর্ন খাবে এবং পছন্দের গানগুলো তাকে গেয়ে শোনাবে। এভাবেই চলল প্রায় ১৫-২০ দিন। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। জয়নাল সাহেবের দীর্ঘদিনের পরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। খানিকটা প্লেবয় প্রকৃতির। কথা প্রসঙ্গে জানাল, সে তার হবুবধূ বন্ধুটির বেশ পরিচিত। নিজের মনের কথা গোপন রেখে সে মেয়েটির খোঁজখবর জানতে চাইল। সমাজে সৎ মানুষ হিসেবে যেহেতু জয়নাল সাহেব ব্যাপক পরিচিতি এবং বিশ্বস্ততা রয়েছে, তাই বন্ধুটি কোনো সন্দেহ করল না। বরং নির্দ্বিধায় মেয়েটির ইতিহাস বর্ণনা করল। জানা গেল, মেয়েটি মূলত হাই সোসাইটির কলগার্ল। সমাজের অনেক বিত্তবানকে সে সর্বনাশ করেছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না জয়নাল সাহেবের। বন্ধুটি কয়েকজনের নাম বললেন এবং এও বললেন- কে কত টাকা ওই মেয়ের পেছনে খরচ করেছে। জয়নাল সাহেব এসএমএস দিয়ে মেয়েটিকে ঘটনার সত্যতা জিজ্ঞাসা করলেন এবং মেয়েটিও নির্দ্বিধায় সব স্বীকার করল। মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো জয়নাল সাহেবের। মনের দুঃখে তিনি চলে গেলেন ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে সেই জাহাজ মার্কা বাড়িটির কাছে। রাত তখন প্রায় ১১টা। কোনো প্রেমিক জুটিই সেখানে ছিল না। কেবল জয়নাল সাহেব একা। আনমনে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত চাঁদের দিকে। কোনো খেয়াল ছিল না। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলেন; কাঁধে কার যেন শক্ত হাতের স্পর্শে। তাকিয়ে দেখলেন একজন হিজড়া তার ঘাড়ে হাত রেখে অশ্লীলভাবে হাসছে। ভয়ে জয়নাল সাহেবের মুখ পাংশু বর্ণ হয়ে গেল। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে কাউকে ডাকবেন সেই শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন...।
প্রকাশঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, শুক্রবার ২৬ অক্টোবর ২০১২

এই সরকার পদ্মা সেতুর একটি খুঁটিও গাড়তে পারবে না

বিশেষ সাক্ষাৎকার : গোলাম মওলা রনি
গোলাম মওলা রনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পটুয়াখালীর একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তরুণ এই সংসদ সদস্য ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন নিজ দলের অনেক মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে। তিনি কালের কণ্ঠের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুজ্জামান তুহিন

কালের কণ্ঠ : ২৩ দফা দিয়ে আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন; কিন্তু একটি দফাও আপনারা পূরণ করতে পারেননি। কেন?
গোলাম মওলা রনি : আসলে বাংলাদেশে যাঁরা নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করেন, মাঠের রাজনীতি ও প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। এটা শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সত্য। এ কাজটি করেন একধরনের বুদ্ধিজীবী, যাঁদের 'হরবোলা' বলা হয়। তাঁরা হল ভাড়া করা বুদ্ধিজীবী। মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য কাব্য দিয়ে তাঁরা এসব নির্বাচনী ইশতেহার বানান। এভাবে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, যা বাস্তবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যেমন প্রতিটি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়া- এটা পৃথিবীর কোনো দেশ কখনোই পারবে না। অথচ বিষয়টি কিন্তু এমনভাবে বলা যেত, সরকার এমন একটি অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করবে, যাতে প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন প্রত্যক্ষভাবে হোক অথবা পরোক্ষভাবে হোক, অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
তবে এই সরকারের কিছু অবিস্মরণীয় কাজ রয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত নয়, সারা পৃথিবীতে ব্যতিক্রম। এর মধ্যে একটি হলো পাটের জেনম আবিষ্কার। পাশাপাশি ছত্রাকের আক্রমণের কারণ আবিষ্কার করা গেছে। এটা কিন্তু সারা পৃথিবীতে আর কেউ পারেনি। এর ফলে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে যাবে।
পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে শিল্পকারখানা তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রচুর শ্রমিক কাজ করতেন। বাংলাদেশে যে গার্মেন্টগুলো চলছে, সেগুলো কিন্তু শিল্প নয়। কোনো গার্মেন্ট মালিক কিন্তু বলতে পারবেন না, আমাদের এখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, বীমা আছে, গ্রাচুইটি আছে। এসব শিল্প নয়, এগুলো সব বোগাস। গার্মেন্ট, এই অর্থনীতি টলটলায়মান। এ অবস্থা থেকে সরকার মাইক্রো লেভেলে, কৃষিতে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে। কৃষি একটা শিল্প। ফলে কৃষকরা নানা ধরনের নতুন নতুন ফসল উদ্ভাবন করছেন, যা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এ সরকারের এটাই সফলতা।
সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন কিন্তু বিদ্যুতের হাহাকার ছিল। এখন কুইক রেন্টালের যে সমালোচনা আছে, সেটা ঠিক আছে। মানুষ কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এই সরকারের আমলে কিন্তু ৭০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আমরা মেরামত করেছি। ৬০টির মতো দরিদ্র ভাতা রয়েছে, যা আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। শিক্ষা খাতেও আমাদের সাফল্য রয়েছে।
আমরা রাস্তাঘাট আশা করি ইংল্যান্ড-আমেরিকার মতো; কিন্তু ট্যাক্স দিই বাংলাদেশের মতো। তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনার দাবি অনুযায়ী আপনাদের সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে। সেগুলো কেন প্রচার করছেন না?
গোলাম মওলা রনি : আওয়ামী লীগের প্রচার বিভাগ মারাত্মক দুর্বল। সরকারের বিভিন্ন প্রচার বিভাগ ও পার্টির প্রচার বিভাগের মধ্যে যে সমন্বয় থাকবে, তা হয়নি। ফলে সরকারের সাফল্যগুলোর কোনো প্রচার নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, ঢাকা মহানগর প্রচার সম্পাদক অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ প্রচার বিভাগগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারের যে উন্নয়নমূলক কাজ, তা দলের প্রচার বিভাগের কাছে নেই। তারা কী করে সরকারের সাফল্য প্রচার করবে?
এ কাজটি করার মতো যে দক্ষতা, তা কিন্তু প্রচার বিভাগের নেই। আপনি এখনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক নূহ উল লেনিন সাহেবের কাছে যান, তাঁকে গিয়ে আই ফোন-৪-এর বিষয় কথা বলেন, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। সরকার চায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আর তার আশপাশের মানুষ হলো এনালগ।
কালের কণ্ঠ : আপনার মতো সরকারও দাবি করছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের উন্নয়ন হয়েছে। অথচ গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবের কারণে শত শত কলকারখানা উৎপাদনে যেতে পারছে না।
গোলাম মওলা রনি : আমরা বিদ্যুতের উন্নয়ন বলতে আসলে বুঝিয়েছি বাতি জ্বলা। আগে যেখানে বিদ্যুৎ যেত ২০ বার, আমরা সেটাকে কমিয়ে এনে পাঁচবারে এনেছি। উন্নতি বলতে এটুকু। সফলতা হলো- বিএনপি সরকারের আমলে খাম্বা টানা হয়েছিল; কিন্তু বিদ্যুৎ দেওয়া হয়নি। এই সরকারের আমলে আমরা প্রায় ২৪ লাখ বিদ্যুতের কানেকশন দিয়েছি। এতে প্রায় এক কোটি লোক নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে।
আর গ্যাসের বিষয়টি ভিন্ন। গ্যাসের সমস্যার সমাধান হয়নি শাসক দলগুলোর সঙ্গে ও দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কারণে। এই টোটাল সেক্টরটি চলে গেছে বিদেশিদের হাতে। বাপেক্স দুর্বল হয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমরা একটি রিগ ক্রয় করেছি। আমরা কৈলাসটিলা, সুন্দলপুর, সূনেত্রতে গ্যাস পেয়েছি। বেশ কিছু জায়গা থেকে গ্যাস উত্তোলনও করেছি।
আমার নিজের একটা কম্পানি কিন্তু আর্থিক লোকসানির কারণে বিক্রি করে দিয়েছি। কারণ সময়মতো গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাইনি। যখন পেয়েছি তখন আমার আর্থিক ক্ষতি এত বেশি যে তা আর নতুন করে চালু করতে পারব না।
গ্যাস সংকটের কারণে সারকারখানাগুলো আট মাস বন্ধ থাকে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের ৫০ শতাংশও সরবরাহও করা যায় না। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকছে। এ অবস্থায় আমরা শত শত কোটি টাকা খরচ করে রাজশাহী পর্যন্ত গ্যাসের পাইপলাইন টেনে নিয়ে গেছি। এটা হলো পুরোটাই অপরিকল্পিত শাসনের চিত্র।
কালের কণ্ঠ : আপনার বলছেন আপনাদের সরকারের আমলে বাপেক্স শক্তিশালী হয়েছে আর বিগত সরকারগুলো বিদেশিদের কাছে গ্যাস সেক্টর তুলে দিয়েছে। কিন্তু সাড়া জাগানো বিকল্প গণমাধ্যম উইকিলিস সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেএফ মরিয়র্টিকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী কথা দিয়েছেন যে সাগরে দুটি বিরোধীহীন ব্লক দেওয়া হবে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পেছনে এসব দেওয়া-নেওয়ার একটা সম্পর্ক আছে?
গোলাম মওলা রনি : বাপেক্সের যে সক্ষমতা তা স্থলভাগের। এর বাইরে তারা সাগরে কাজ করেনি। সেই কারিগরি জ্ঞান ও যন্ত্রপাতিও আমাদের নেই। দেখুন, বাংলাদেশে সব থেকে বেশি গ্যাস উত্তোলন করে শেভরন। এখন শেভরনের যে সক্ষমতা তা যদি অর্জন করতে হয় তাহলে বাপেক্সকে যদি সরকার সাপোর্ট দেয় তবু ১০ বছর লাগবে। সমুদ্রে কাজ করার জন্য আরো অনেক প্রস্তুতি দরকার। তবে সে ক্ষেত্রে জয়েন্টভেঞ্চার করা যেতে পারে। সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনের জন্য আমাদের বিদেশি কম্পানির সঙ্গে যেতেই হবে।
শুধু আমাদের মতো দেশ নয়, সৌদি আরব-ইরানের মতো দেশের তেল-গ্যাস সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দখলে রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো প্রেশার আছে কি না আমি জানি না। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত তাঁদের দেশের কোনো ব্যবসায়ীর ছোট কোনো স্বার্থ থাকলেও ছুটে আসবেন। এটা তাঁদের পলিসি। হয়তো এ কারণেই জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁরা দেখা করেছেন। জ্বালানি উপদেষ্টা তখন হয়তো বলেছেন, আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ যা যা করার তা করব। এটা একটা কূটনৈতিক পরিভাষা। এটাই হয়তো উইকিলিস ফাঁস করেছে।
কালের কণ্ঠ : যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যে প্রভাব, সেখানে কি তাদের সঙ্গে আমাদের এ ধরনের কূটনৈতিক সাদামাটা আশ্বাস দেওয়ার মতো পর্যায় আছে?
গোলাম মওলা রনি : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেন থাকবে না! আমরা তাদের ভয় করছি এমনি এমনি। সাপের দংশনে যেসব মানুষ মারা যায় তাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মারা যায় হার্ট অ্যাটাক করে। কারণ আমাদের দেশের ১ শতাংশ সাপে বিষ আছে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের দেশের মানুষের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করি চীন থেকে, আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় জাপান আর আমরা ভয় পাই আমেরিকাকে!
কালের কণ্ঠ : আপনার ভাষ্য মতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এই সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের কি নতুন কোনো বাজার তৈরি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
গোলাম মওলা রনি : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শতভাগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে নয়। আমাদের একটি মিশনে অনেক কাজ রয়েছে, যার মধ্যে অনেক বিভাগ কাজ করে। ফলে কাজের সমন্বয় হয় না। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন ডাক্তার। ডাক্তারি শিখে তিনি গেলেন যে আমি আর ডাক্তারি করব না, আমি এখন উকালতি করব। এখন তিনি রাজনীতি করতে এসে মন্ত্রী হয়ে গেলেন। মন্ত্রী হয়ে তিনি ১৩৭টি দেশ ভ্রমণ করলেন। যদি প্রতিটি ভ্রমণে পাঁচ দিন করে সময় লাগে, তাহলে কত দিন লাগে (৬৮৫ দিন)?
এখন বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে যদি দেশের অর্থনৈতিক বাজার খোঁজার জন্য নিয়োজিত করতে হয় তাহলে দরকার তো তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণার। এখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো সাহায্যকারী নেই, তাঁর প্রতিমন্ত্রী নেই। সে সময় তিনি পাননি। বাংলাদেশের শুধু মানবসম্পদই নয়, দেশের ব্যাটারি, ওষুধ, গার্মেন্ট পণ্য, চানাচুর, আমাদের সবজি- সব কিছু রপ্তানি করা যায়।
আমাদের দেশের পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পর্যটন নামে আমাদের দূতাবাসগুলোতে আলাদা কোনো বিভাগ নেই। কিন্তু যদি আপনি সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করেন তাহলে আমাদের দূতাবাসগুলোতে কিন্তু সুযোগ-সুবিধার অভাব নেই। দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিএনপির সময় ৯২ সালে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য সে সময় বিএনপি ঠিক করল তারা জাপানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করবে। এ জন্য বিএনপি মোর্শেদ খানকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বানিয়ে দিলেন। মোর্শেদ খান অনেক কাজ করলেন। এরপর যখন বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলো, মোর্শেদ খানকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। জাপানের সঙ্গে কিন্তু সেই থেকে আমাদের সম্পর্ক ভালো।
বর্তমান সরকার চীন, ভারত, মালেশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এগুলোর তো ধারাবাহিকতা দরকার। যদি এর পরের সরকার তা না করে তাহলে কিন্তু হলো না।
কালের কণ্ঠ : সরকারের শেষ সময় নুতন মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হলো। এর মধ্যে কয়েকজনকে ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। আপনি এই নতুন মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
গোলাম মওলা রনি : মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। তাঁর মেধা, যোগ্যতা, তাঁর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মেলে- এসব ভেবেই তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আসলে আমাদের কারো কিছু বলার নেই। এখানে যদি কোনো সফলতা আসে, সেটাও প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব। আর যদি সমাালোচনা আসে, তাহলে সেটাও তাঁর।
যেহেতু সরকারের শেষ সময়, সরকার যে গতিতে আগাচ্ছিল, এই মন্ত্রিসভার পরিবর্তনের কারণে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না।
কালের কণ্ঠ : এবার আসি বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে। আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে? এ সরকারের সময়ে কি পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে?
গোলাম মওলা রনি : বিশ্বব্যাংক নিয়ে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণে একবার বললেন, পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থে করব। আবার বললেন, রেল সেতু বাদ দিয়ে পদ্মা সেতু করব। আমি এ কথাটির জন্য তাঁকে সালাম জানাই। আজ থেকে তিন বছর আগে এ বিষয়ে সংসদে যে মিটিং হয়েছিল, সেখানে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংক এই সরকারের আমলে টাকা দেবে না। পদ্মা সেতু তৈরি তো দূরের কথা, আপনারা একটা খুঁটিও গাড়তে পারবেন না এই সরকারের আমলে। পারলে নিজেদের অর্থায়নে করুন। প্রধানমন্ত্রীকে বোঝান। কারণ যেসব কাগজপত্র আদান-প্রদান হয়েছে, তা পড়ে এটা আমার মনে হয়েছে। সেখানে তৎকালীন সচিব ও যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনও ছিলেন।
এই পদ্মা সেতুটির সঙ্গে যদি রেল সেতু করেন তাহলে ব্যয় দাঁড়াবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এই বারো হাজার কোটি থেকে ব্যয় বাড়তে বাড়তে এটা হয়েছে এখন ২৬ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর যে আট মাস দেরি হলো, তাতে আরো দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। আর যদি আপনি শুধু সড়ক সেতু করেন তাহলে আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকায় হয়ে যাবে। আমরা ২০ হাজার কোটি বাড়তি খরচ করে রেল সেতু করছি; কিন্তু আগামী ২০ বছরেও কিন্তু রেল চালু করতে পারব না। কারণ রেল চালু করতে হলে রেললাইনের পেছনেসহ অন্যান্য খরচ হবে আরো ৬০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে আমরা ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করতে পারি না, কিভাবে ৬০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করব? ফলে এই রেল সেতুতে তখন আপনাকে বাচ্চাদের খেলনা চালাতে হবে। এটা পড়ে থাকবে।
বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা নিয়ে সরকার ভয়াবহ বিব্রত হবে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে বসবে। তারপর বড় বড় কর্তাদের মিডিয়ার সামনে এনে পর্যুদস্ত করবে। দেখবেন তখন সরকারের কাপড়চোপড়ও থাকবে না। তখন না পারবে গিলতে, না পারবে ঠেলতে। তখন যদি সরকার কোনোভাবে কিছু বলে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বলবে, দুর্নীতি তদন্তে সহায়তা না করায় আমরা গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের খপ্পরে যারা একবার পড়েছে, তাদের সব কিছু গেছে। হয় আপনাকে শেষ করে দেবে, নতুবা একদম কুকুরের মতো মাথা নত করে প্রভুর সামনে থাকবেন। আমরা ভিক্ষুকদের সঙ্গে যেমন আচরণ করি, বিশ্বব্যাংকও আমাদের সঙ্গে সে রকম আচরণ করে।
কোটি কোটি মাথাকে বিকিয়ে দিয়ে আমাদের পদ্মা সেতু দরকার কি না, তা ভাবতে হবে।
চুয়াত্তর সালে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার কবলে পড়ে কিন্তু দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বাংলাদেশে। আমরা আবার সেদিকে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের আমলে শেয়ার, ডেসটিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটছে। আপনারা মূলত তরুণদের ভোটে ক্ষমতায় এসেছেন। এই তরুণদের জন্য আগামী নির্বাচনে কী বলবেন?
গোলাম মওলা রনি : শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় সবাই হতবাক হয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা তরুণদের ভোটের কারণে বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়েছি। এই কেলেঙ্কারির জন্য আমাদের সামাজিক যে অবিচার, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। তবে সরকার চেষ্টা করছে। হলমার্ক যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে তা কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। মিডিয়া এই দুর্নীতির বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছে। সরকারদলীয় যেসব লোকের নাম আসছে, সরকারের উচিত তাঁদের কোনো ছাড় না দেওয়া। জাতীয়ভাবে তরুণ ভোটারদের কী বলা হবে, সে বিষয়ে হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন পরিচালনা বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু আমার এলাকার তরুণ ভোটাররা আমার পক্ষেই আছে। ভোট যার অধীনেই হোক না কেন, আমি সেখান থেকে আগের থেকে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে আসব।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয়, সব দল নিয়ে একটি নির্বাচন হবে?
গোলাম মওলা রনি : নির্বাচন এ দেশে হবে। তবে কার অধীনে হবে সে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি। এই মুহূর্তে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনে বলা যাবে না, রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে। রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
গোলাম মওলা রনি : আপনাকে ও কালের কণ্ঠ পরিবারকেও ধন্যবাদ।কালের কণ্ঠ, রবিবার ৭ অক্টোবর ২০১২, ২২ আশ্বিন ১৪১৯, ২০ জিলকদ ১৪৩৩