অভিনেত্রী শাওন কাঁদছেন। সম্ভবত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াত আত্দাও
কাঁদছে। কাঁদছে বিশ্বব্যাপী হুমায়ূনের কোটি কোটি ভক্ত ও অনুরাগী। শাওনের মা
তহুরা আলী আমার প্রিয় সহকর্মী। সংসদ সদস্য। তার বাবাও দেশের প্রথিতযশা
ব্যবসায়ী। আমি তাদের চিনেছি অনেক পর। শাওনকে চিনেছি আগে। আশির দশকে নতুন
কুঁড়ির মাধ্যমে। চিনতাম ঈশিতা এবং তারিনকেও। বাংলাদেশের কোটি কোটি টেলিভিশন
দর্শকের কাছে অত্যন্ত প্রিয় নাম শাওন। ঈশিতা বিয়ে করে সুখী জীবনযাপন করছে।
অনিয়মিতভাবে টেলিভিশন পর্দায় হাজির হলেও তার সুখী জীবন আমাদের আনন্দিত
করে। তারিনের বিয়ে বিচ্ছেদের পর আমরা ব্যথিত হয়েছিলাম, পরবর্তীতে এ নিয়ে
তেমন কোনো বিতর্ক না হওয়ায় আমরা উৎকণ্ঠিত হইনি। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটল
শাওনের জীবনে।
শাওন যখন হঠাৎ করেই লেখক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন- সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠল। চারদিকে ছি: ছি: রব উঠল। বলতে গেলে কোনো বাছ-বিচার না করেই। হুমায়ূন আহমেদ বাধ্য হয়েই একটি জাতীয় দৈনিকে আত্দপক্ষ সমর্থন করে কলাম লিখলেন; কিন্তু সমালোচনা থামল না। আমি এ বিষয় নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলাপ করলাম। দেখলাম সবাই বিরূপ। আমি বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করেছি। যদিও বয়সের দিক থেকে প্রেম ও প্রণয়টি অসম ছিল; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা অনৈতিক, বেআইনি বা অবৈধ ছিল না। বরং চিরন্তন প্রেমের দুর্বার আকর্ষণে মেধাবী শাওন কিভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং হুমায়ূন আহমেদের মতো বিদ্বজ্জন-পণ্ডিত মানুষ সমাজ সংসারের মতো বাধা উপেক্ষা করে প্রেয়সীর হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন- তা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। আমার জানা মতে, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য ছিল দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনের অনেকেই তা জানত। জানত একথাও যে, তারা দুই বছর কার্যত আলাদা বসবাস করছিলেন। হুমায়ূনের মনের এই অন্তর্দহনের সন্ধিক্ষণে সম্ভবত শাওনের আগমন।
হুমায়ূন-শাওনের প্রেম ও বিয়ের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো- তারা ভণ্ডামি বা চুপি চুপি কোনো অবৈধ কাজ করেননি। অথচ আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রথা হলো-বিখ্যাত মানুষেরা অহরহ কোনো কেলেঙ্কারি করে যাবেন আর সমাজ তা চেয়ে চেয়ে দেখবে। যে সময় হুমায়ূন-শাওনের প্রণয় সংঘটিত হয় ওই সময় হুমায়ূন একজন ডিভোর্সি নিঃসঙ্গ পুরুষ হিসেবে ছিলেন। প্রচলিত সমাজে এ বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই হতো না, যদি না পাত্র-পাত্রী হুমায়ূন আহমেদ ও শাওনের মতো বিখ্যাত না হতেন।
টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শাওন বলার চেষ্টা করেছেন তাদের দাম্পত্য জীবনের পারিপাশ্বর্িক বেদনা ও অন্তর্ঘাত সম্পর্ক। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সারা জীবনের নাট্যাভিনয়ের মতো কুশলতা জানা সত্ত্বেও নিজের জীবননাট্যে তিনি অভিনয় করতে পারেননি। তিনি ছিলেন বাকরুদ্ধ এবং যা বলা উচিত ছিল তা আবেগের কারণে গুছিয়ে বলতে পারেননি। হুমায়ূন-শাওন প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন একটি সুখী গৃহকোণ গড়ে তোলার। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তারা সেটি পারেননি। আমাদের সমাজ সেটি করতে দেয়নি। দু'পরিবারের নিকটজনের সমালোচনা, অসহযোগিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক নির্যাতন তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল প্রতিনিয়ত। তারা যে ভালো নেই তা আমি বুঝেছিলাম তাদের জীবনযাত্রার ধরন দেখে। বিবাহ পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও বিভিন্ন লেখায় সাবেকী টান বা চিরায়ত আকর্ষণ ছিল না। এরই মধ্যে শাওন অন্তঃসত্ত্বা হন এবং কিছুদিন পর তার গর্ভপাত ঘটে। পত্র-পত্রিকায় এ গর্ভপাতের বিষয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় শাওনের মনের অশান্তি ও গর্ভপাতের অন্যতম কারণ ছিল। যাই হোক, বছর দুয়েকের মধ্যে এই দম্পতি দৃশ্যত অনেক কিছু গুছিয়ে নিলেও সমাজ তাদেরকে ছাড়েনি।
মেহের আফরোজ শাওন তার বয়সের তারুণ্যের কারণে অনেক সামাজিক বাধা উপেক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু হুমায়ূন হয়তো পারেননি। ফলে নিজের অজান্তে তিনি কাঁদতেন। কাঁদতেন প্রতিনিয়ত, বিশেষ করে আগের সংসারের ছেলেমেয়ে নুহাশ, শিলা ও নোভার কথা মনে করে। তারাও হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে খুবই নির্মম আচরণ করতেন। পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, শিলার বিয়ে এবং সেই বিয়েতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আমন্ত্রিত হওয়ার উপাখ্যান। বড়ই বেদনাদায়ক এবং মর্মস্পর্শী। এত বেদনা বহন করার বয়স হয়তো হুমায়ূন আহমেদের ছিল না। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধে। আমার কেন জানি মনে হয়, আমরাই হুমায়ূন আহমেদকে মেরে ফেলেছি এবং তার বিধবা স্ত্রীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছি।
এ লেখা যখন লিখছি তার কিছুক্ষণ আগে আমাকে মিলি ভাবী ফোন করেছিল আমার একটি লেখার বিষয়ে মন্তব্য জানানোর জন্য। মিলি ভাবী মানে মিলি রহমান। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বিধবা স্ত্রী। এরপরই শাওনের সাক্ষাৎকারটির কথা মনে পড়ল। সাক্ষাৎকারের মূল কারণ মনে হচ্ছে, সমাজ সংসারের সমালোচনার জবাবে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। চ্যানেল আইয়ের মালিক ফরিদুর রেজা সাগর প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন। সম্ভবত সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি চ্যানেল আইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় টকশো অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায় শাওনের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। যা বলছিলাম, সাক্ষাৎকারে শাওন বার বার বলার চেষ্টা করেছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী হিসেবেই সারাজীবন থাকতে চান। তার এই কথায় আমার মিলি ভাবীর কথা মনে হলো। মিলি রহমান যখন ১৯৭১ সালে বিধবা হন, তখন তো তার বয়স শাওনের চেয়েও কম ছিল এবং তার পারিবারিক এবং পারিপাশ্বর্িক অবস্থা ছিল আরও প্রতিকূলে। কাজেই সেই মিলি ভাবী যদি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমাদের শাওন কেন পারবেন না?
আরেকটি বিষয় মনে হলো যে, শাওনের চারপাশের পরিবেশ হয়তো তার ব্যক্তিগত চরিত্রে কিংবা ভবিষ্যৎ প্রণয়ের সম্ভাবনা নিয়ে বিরাম সমালোচনা করছে। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে বিভিন্ন কল্প- কাহিনীও প্রচার হয়েছে। এক মহাউৎসাহী হুমায়ূন ভক্ততো মামলাই করে ফেললেন। আমার বক্তব্য হলো- শাওনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার নৈতিক অধিকার কেবল তার নিজের বা ক্ষেত্রবিশেষে পিতামাতার। অযথা সমালোচনা করে তাকে বিব্রত করছি কেন? সেই কবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছেন পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে, অথচ প্রায় ২০০ বছর পর আমরা বিধবা শাওনের জন্য সেই প্রথা পুনরায় কার্যকর করতে যাচ্ছি। আমাদের ইচ্ছা- হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গেই শাওনের মরা উচিত ছিল। সেহেতু নিদেনপক্ষে তা হয়নি। কাজেই সারাজীবন সাদা বসনের ধবধবে শাড়ি পরেই শাওনকে সমাজে চলাফেরা করতে হবে।
বর্তমানে শাওনকে ঘিরে যেসব সমালোচনা হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান উপকরণ হচ্ছে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের বিষয়-সম্পত্তি। সবার সন্দেহ- শাওন সব বিষয়-আশয়, সম্পত্তি কুক্ষিগত করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা উচিত যে- হুমায়ূন আহমেদ একজন অধ্যাপক কাম-লেখক ছিলেন। তিনি বিল গেটস, রকফেলার, স্টিভ জবস কিংবা ভারতের ধীরুভাই আম্বানীর মতো ব্যবসায়ী ছিলেন না। তার সহায়-সম্পত্তি বলতে হয়তো ঢাকাতে ২/১টি ফ্ল্যাট, গাজীপুরের অজপাড়াগাঁয়ে 'নুহাশ পল্লী' নামের একটি বাগানবাড়ি বা সেন্টমার্টিন দ্বীপে একখণ্ড জমির ওপর একটি টিনের ঘর। হুমায়ূনের জাদুকরি কলম ও বিভিন্ন নাটকের কারণে ওইগুলোকে অমূল্য সম্পদ মনে হলেও বাস্তব মূল্য কিন্তু বেশি নয়। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ধনী ব্যক্তিরও এরচেয়ে বেশি সম্পদ আছে। আর শাওন তো কোনো সাধারণ পরিবারের সন্তান নন। হুমায়ূন আহমেদ হয়তো সারাজীবন সঞ্চয়ের মাধ্যমে তিল তিল করে যে বিষয়-সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন শাওন তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি সম্পদ পেয়েছেন। কাজেই হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য নিকটাত্দীয়ের কাছে তার সহায়-সম্পত্তি হয়তো প্রিয় হতে পারে; কিন্তু শাওনের কাছে হুমায়ূনের স্মৃতিই সবচেয়ে মূল্যবান। অন্য কোনো সম্পত্তি নয়। আমি এত দৃঢ়ভাবে শাওনের পক্ষে বলতে পারছি নিজের জীবনের একটি বিবাহ-পরবর্তী পরিণয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। শাওন যেভাবে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তা কোনো মামুলি ঘটনা ছিল না। বিস্ময়কর প্রেমের অবিস্মরণীয় দৃঢ়তা ও ইচ্ছাশক্তি এবং সর্বোপরি মোহময় আকর্ষণে একে অপরের প্রতি আস্থাশীল হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কাজেই আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা করি নিজের জীবনের একটি খণ্ডিত ঘটনার বিরূপ অভিজ্ঞতার জন্য। সেটিও ছিল বিবাহ-পরবর্তী প্রেম। যা এসেছিল আমার জীবনে সেই ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে। এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী হঠাৎ করেই আমার প্রেমে পড়ে। তরুণীর রূপ, লাবণ্য, শিক্ষা-দীক্ষা এবং বংশ মর্যাদা সব পুরুষের জন্যই একান্ত কাম্য। আমিও আকর্ষিত হলাম। সারা জীবনে কোথাও প্রতারণার আশ্রয় নেইনি। তাই পরিচয়ের প্রথম পর্বেই বললাম, আমি বিবাহিত এবং দু'সন্তানের জনক। খুব কষ্ট হচ্ছিল সত্যি কথা বলতে। কিন্তু বলেছিলাম এই আশায় যে, হয়তো তরুণীটি আমাকে পছন্দ করবে না। প্রথমে সে খুব কাঁদল এবং আমাকে গালাগালও দিল। আমি নির্বোধ ও নির্বাক হয়ে রইলাম। বললাম, আমার কী দোষ। গতকালই তোমার সঙ্গে দেখা হলো এবং বুঝতে পারলাম তুমি আমার প্রতি আকৃষ্ট। তাই সত্য কথা বললাম। এরপরও যদি এগুতে চাও আমি রাজি! কিন্তু সে রাজি হলো না। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। ব্যথাভরা হৃদয়ে আমি আমার কর্মস্থলে ফিরলাম এবং মনে মনে তার নাম রাখলাম অনামিকা। কিন্তু তিন/চার দিন পর অনামিকা আমার অফিসে এলো এবং বলল, আমাকে ছাড়া নাকি তার চলবে না। আমার ব্যবসাও তখন ছোট। একটি বউ নিয়ে চলতে কষ্ট। দুই বউ বা সংসার কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু অনামিকার প্রবল আকর্ষণ আমাকেও বিভোর করে তুলল। মনে হচ্ছিল দেখি না কী হয়। সে নিয়মিত অফিসে আসত এবং দীর্ঘক্ষণ অফিসে বসে থাকত। আমার তখন আলাদা রুম ছিল না। সবার সামনে যেমন সে বসে থাকত আর আমিও তাকে বসিয়ে রেখে সব কাজ করতাম। সে আমাকে হুমকি দিত আমি যদি তাকে বিয়ে না করি তবে সে আত্দহত্যা করবে। আমি ভীষণ ভয় পেলাম। ভয় পেলে মানুষ বেকুবের মতো আচরণ করে, বোকা হয়ে যায়। আমার অবস্থাও তদ্রূপ হলো। আমি আমার স্ত্রীর কাছে সব খুলে বললাম। আর যায় কোথায়, শুরু হলো তুফান। সবকিছু ধ্বংস হয় হয় অবস্থা। এরই মধ্যে অনামিকা আমার অফিসে আসা বন্ধ করে দিল। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। আমি ইডেন কলেজে দেখা করতে গেলাম। দেখা হলো না। কিন্তু একটি চিরকুট পেলাম। সে লিখেছে- 'এই কয়দিন তোমার সঙ্গে চলাফেরা করে তোমাকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি অনেক বড় হবে, বিখ্যাত হবে এবং সম্পদশালী হবে। অন্যান্য সফল মানুষের মতো তুমিও তাড়াতাড়ি মরবে। আর তোমার মৃত্যুর পরই শুরু হবে আমার দুর্ভোগ। তোমার পরিবারের সবাই তোমার প্রথম স্ত্রীর পক্ষ নেবে এবং আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে আমি আমার বাবা-মার পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকব। ওই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না আমার। কাজেই তোমার আমার বিয়ের স্বপ্ন এখানেই শেষ। বিদায়।'
প্রকাশ : ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০১২, বাংলাদেশ প্রতিদিন
শাওন যখন হঠাৎ করেই লেখক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন- সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠল। চারদিকে ছি: ছি: রব উঠল। বলতে গেলে কোনো বাছ-বিচার না করেই। হুমায়ূন আহমেদ বাধ্য হয়েই একটি জাতীয় দৈনিকে আত্দপক্ষ সমর্থন করে কলাম লিখলেন; কিন্তু সমালোচনা থামল না। আমি এ বিষয় নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলাপ করলাম। দেখলাম সবাই বিরূপ। আমি বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করেছি। যদিও বয়সের দিক থেকে প্রেম ও প্রণয়টি অসম ছিল; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা অনৈতিক, বেআইনি বা অবৈধ ছিল না। বরং চিরন্তন প্রেমের দুর্বার আকর্ষণে মেধাবী শাওন কিভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং হুমায়ূন আহমেদের মতো বিদ্বজ্জন-পণ্ডিত মানুষ সমাজ সংসারের মতো বাধা উপেক্ষা করে প্রেয়সীর হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন- তা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। আমার জানা মতে, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য ছিল দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনের অনেকেই তা জানত। জানত একথাও যে, তারা দুই বছর কার্যত আলাদা বসবাস করছিলেন। হুমায়ূনের মনের এই অন্তর্দহনের সন্ধিক্ষণে সম্ভবত শাওনের আগমন।
হুমায়ূন-শাওনের প্রেম ও বিয়ের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো- তারা ভণ্ডামি বা চুপি চুপি কোনো অবৈধ কাজ করেননি। অথচ আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রথা হলো-বিখ্যাত মানুষেরা অহরহ কোনো কেলেঙ্কারি করে যাবেন আর সমাজ তা চেয়ে চেয়ে দেখবে। যে সময় হুমায়ূন-শাওনের প্রণয় সংঘটিত হয় ওই সময় হুমায়ূন একজন ডিভোর্সি নিঃসঙ্গ পুরুষ হিসেবে ছিলেন। প্রচলিত সমাজে এ বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই হতো না, যদি না পাত্র-পাত্রী হুমায়ূন আহমেদ ও শাওনের মতো বিখ্যাত না হতেন।
টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শাওন বলার চেষ্টা করেছেন তাদের দাম্পত্য জীবনের পারিপাশ্বর্িক বেদনা ও অন্তর্ঘাত সম্পর্ক। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সারা জীবনের নাট্যাভিনয়ের মতো কুশলতা জানা সত্ত্বেও নিজের জীবননাট্যে তিনি অভিনয় করতে পারেননি। তিনি ছিলেন বাকরুদ্ধ এবং যা বলা উচিত ছিল তা আবেগের কারণে গুছিয়ে বলতে পারেননি। হুমায়ূন-শাওন প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন একটি সুখী গৃহকোণ গড়ে তোলার। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তারা সেটি পারেননি। আমাদের সমাজ সেটি করতে দেয়নি। দু'পরিবারের নিকটজনের সমালোচনা, অসহযোগিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক নির্যাতন তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল প্রতিনিয়ত। তারা যে ভালো নেই তা আমি বুঝেছিলাম তাদের জীবনযাত্রার ধরন দেখে। বিবাহ পরবর্তী সময়ে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও বিভিন্ন লেখায় সাবেকী টান বা চিরায়ত আকর্ষণ ছিল না। এরই মধ্যে শাওন অন্তঃসত্ত্বা হন এবং কিছুদিন পর তার গর্ভপাত ঘটে। পত্র-পত্রিকায় এ গর্ভপাতের বিষয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় শাওনের মনের অশান্তি ও গর্ভপাতের অন্যতম কারণ ছিল। যাই হোক, বছর দুয়েকের মধ্যে এই দম্পতি দৃশ্যত অনেক কিছু গুছিয়ে নিলেও সমাজ তাদেরকে ছাড়েনি।
মেহের আফরোজ শাওন তার বয়সের তারুণ্যের কারণে অনেক সামাজিক বাধা উপেক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু হুমায়ূন হয়তো পারেননি। ফলে নিজের অজান্তে তিনি কাঁদতেন। কাঁদতেন প্রতিনিয়ত, বিশেষ করে আগের সংসারের ছেলেমেয়ে নুহাশ, শিলা ও নোভার কথা মনে করে। তারাও হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে খুবই নির্মম আচরণ করতেন। পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, শিলার বিয়ে এবং সেই বিয়েতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আমন্ত্রিত হওয়ার উপাখ্যান। বড়ই বেদনাদায়ক এবং মর্মস্পর্শী। এত বেদনা বহন করার বয়স হয়তো হুমায়ূন আহমেদের ছিল না। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধে। আমার কেন জানি মনে হয়, আমরাই হুমায়ূন আহমেদকে মেরে ফেলেছি এবং তার বিধবা স্ত্রীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছি।
এ লেখা যখন লিখছি তার কিছুক্ষণ আগে আমাকে মিলি ভাবী ফোন করেছিল আমার একটি লেখার বিষয়ে মন্তব্য জানানোর জন্য। মিলি ভাবী মানে মিলি রহমান। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বিধবা স্ত্রী। এরপরই শাওনের সাক্ষাৎকারটির কথা মনে পড়ল। সাক্ষাৎকারের মূল কারণ মনে হচ্ছে, সমাজ সংসারের সমালোচনার জবাবে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। চ্যানেল আইয়ের মালিক ফরিদুর রেজা সাগর প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন। সম্ভবত সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি চ্যানেল আইয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় টকশো অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায় শাওনের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। যা বলছিলাম, সাক্ষাৎকারে শাওন বার বার বলার চেষ্টা করেছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী হিসেবেই সারাজীবন থাকতে চান। তার এই কথায় আমার মিলি ভাবীর কথা মনে হলো। মিলি রহমান যখন ১৯৭১ সালে বিধবা হন, তখন তো তার বয়স শাওনের চেয়েও কম ছিল এবং তার পারিবারিক এবং পারিপাশ্বর্িক অবস্থা ছিল আরও প্রতিকূলে। কাজেই সেই মিলি ভাবী যদি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমাদের শাওন কেন পারবেন না?
আরেকটি বিষয় মনে হলো যে, শাওনের চারপাশের পরিবেশ হয়তো তার ব্যক্তিগত চরিত্রে কিংবা ভবিষ্যৎ প্রণয়ের সম্ভাবনা নিয়ে বিরাম সমালোচনা করছে। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে বিভিন্ন কল্প- কাহিনীও প্রচার হয়েছে। এক মহাউৎসাহী হুমায়ূন ভক্ততো মামলাই করে ফেললেন। আমার বক্তব্য হলো- শাওনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার নৈতিক অধিকার কেবল তার নিজের বা ক্ষেত্রবিশেষে পিতামাতার। অযথা সমালোচনা করে তাকে বিব্রত করছি কেন? সেই কবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছেন পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে, অথচ প্রায় ২০০ বছর পর আমরা বিধবা শাওনের জন্য সেই প্রথা পুনরায় কার্যকর করতে যাচ্ছি। আমাদের ইচ্ছা- হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গেই শাওনের মরা উচিত ছিল। সেহেতু নিদেনপক্ষে তা হয়নি। কাজেই সারাজীবন সাদা বসনের ধবধবে শাড়ি পরেই শাওনকে সমাজে চলাফেরা করতে হবে।
বর্তমানে শাওনকে ঘিরে যেসব সমালোচনা হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান উপকরণ হচ্ছে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের বিষয়-সম্পত্তি। সবার সন্দেহ- শাওন সব বিষয়-আশয়, সম্পত্তি কুক্ষিগত করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা উচিত যে- হুমায়ূন আহমেদ একজন অধ্যাপক কাম-লেখক ছিলেন। তিনি বিল গেটস, রকফেলার, স্টিভ জবস কিংবা ভারতের ধীরুভাই আম্বানীর মতো ব্যবসায়ী ছিলেন না। তার সহায়-সম্পত্তি বলতে হয়তো ঢাকাতে ২/১টি ফ্ল্যাট, গাজীপুরের অজপাড়াগাঁয়ে 'নুহাশ পল্লী' নামের একটি বাগানবাড়ি বা সেন্টমার্টিন দ্বীপে একখণ্ড জমির ওপর একটি টিনের ঘর। হুমায়ূনের জাদুকরি কলম ও বিভিন্ন নাটকের কারণে ওইগুলোকে অমূল্য সম্পদ মনে হলেও বাস্তব মূল্য কিন্তু বেশি নয়। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ধনী ব্যক্তিরও এরচেয়ে বেশি সম্পদ আছে। আর শাওন তো কোনো সাধারণ পরিবারের সন্তান নন। হুমায়ূন আহমেদ হয়তো সারাজীবন সঞ্চয়ের মাধ্যমে তিল তিল করে যে বিষয়-সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন শাওন তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি সম্পদ পেয়েছেন। কাজেই হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য নিকটাত্দীয়ের কাছে তার সহায়-সম্পত্তি হয়তো প্রিয় হতে পারে; কিন্তু শাওনের কাছে হুমায়ূনের স্মৃতিই সবচেয়ে মূল্যবান। অন্য কোনো সম্পত্তি নয়। আমি এত দৃঢ়ভাবে শাওনের পক্ষে বলতে পারছি নিজের জীবনের একটি বিবাহ-পরবর্তী পরিণয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। শাওন যেভাবে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তা কোনো মামুলি ঘটনা ছিল না। বিস্ময়কর প্রেমের অবিস্মরণীয় দৃঢ়তা ও ইচ্ছাশক্তি এবং সর্বোপরি মোহময় আকর্ষণে একে অপরের প্রতি আস্থাশীল হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কাজেই আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা করি নিজের জীবনের একটি খণ্ডিত ঘটনার বিরূপ অভিজ্ঞতার জন্য। সেটিও ছিল বিবাহ-পরবর্তী প্রেম। যা এসেছিল আমার জীবনে সেই ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে। এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী হঠাৎ করেই আমার প্রেমে পড়ে। তরুণীর রূপ, লাবণ্য, শিক্ষা-দীক্ষা এবং বংশ মর্যাদা সব পুরুষের জন্যই একান্ত কাম্য। আমিও আকর্ষিত হলাম। সারা জীবনে কোথাও প্রতারণার আশ্রয় নেইনি। তাই পরিচয়ের প্রথম পর্বেই বললাম, আমি বিবাহিত এবং দু'সন্তানের জনক। খুব কষ্ট হচ্ছিল সত্যি কথা বলতে। কিন্তু বলেছিলাম এই আশায় যে, হয়তো তরুণীটি আমাকে পছন্দ করবে না। প্রথমে সে খুব কাঁদল এবং আমাকে গালাগালও দিল। আমি নির্বোধ ও নির্বাক হয়ে রইলাম। বললাম, আমার কী দোষ। গতকালই তোমার সঙ্গে দেখা হলো এবং বুঝতে পারলাম তুমি আমার প্রতি আকৃষ্ট। তাই সত্য কথা বললাম। এরপরও যদি এগুতে চাও আমি রাজি! কিন্তু সে রাজি হলো না। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। ব্যথাভরা হৃদয়ে আমি আমার কর্মস্থলে ফিরলাম এবং মনে মনে তার নাম রাখলাম অনামিকা। কিন্তু তিন/চার দিন পর অনামিকা আমার অফিসে এলো এবং বলল, আমাকে ছাড়া নাকি তার চলবে না। আমার ব্যবসাও তখন ছোট। একটি বউ নিয়ে চলতে কষ্ট। দুই বউ বা সংসার কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু অনামিকার প্রবল আকর্ষণ আমাকেও বিভোর করে তুলল। মনে হচ্ছিল দেখি না কী হয়। সে নিয়মিত অফিসে আসত এবং দীর্ঘক্ষণ অফিসে বসে থাকত। আমার তখন আলাদা রুম ছিল না। সবার সামনে যেমন সে বসে থাকত আর আমিও তাকে বসিয়ে রেখে সব কাজ করতাম। সে আমাকে হুমকি দিত আমি যদি তাকে বিয়ে না করি তবে সে আত্দহত্যা করবে। আমি ভীষণ ভয় পেলাম। ভয় পেলে মানুষ বেকুবের মতো আচরণ করে, বোকা হয়ে যায়। আমার অবস্থাও তদ্রূপ হলো। আমি আমার স্ত্রীর কাছে সব খুলে বললাম। আর যায় কোথায়, শুরু হলো তুফান। সবকিছু ধ্বংস হয় হয় অবস্থা। এরই মধ্যে অনামিকা আমার অফিসে আসা বন্ধ করে দিল। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। আমি ইডেন কলেজে দেখা করতে গেলাম। দেখা হলো না। কিন্তু একটি চিরকুট পেলাম। সে লিখেছে- 'এই কয়দিন তোমার সঙ্গে চলাফেরা করে তোমাকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি অনেক বড় হবে, বিখ্যাত হবে এবং সম্পদশালী হবে। অন্যান্য সফল মানুষের মতো তুমিও তাড়াতাড়ি মরবে। আর তোমার মৃত্যুর পরই শুরু হবে আমার দুর্ভোগ। তোমার পরিবারের সবাই তোমার প্রথম স্ত্রীর পক্ষ নেবে এবং আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে আমি আমার বাবা-মার পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন থাকব। ওই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না আমার। কাজেই তোমার আমার বিয়ের স্বপ্ন এখানেই শেষ। বিদায়।'
প্রকাশ : ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০১২, বাংলাদেশ প্রতিদিন
I'm speachless. if it is just a story, I dont mind also.
ReplyDeleteGreat..