পরকীয়া নিয়ে কিছু একটা লিখব- এ কথা শুনেই এক পরিচিত লোক বললেন- পরকীয়া
বলছেন কেন। ওটা তো আপনকীয়া। এক ঘরের নিচে বাস করলেও স্বামী-স্ত্রী যেন একে
অপরের থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সমস্যাও আছে বটে। কিন্তু
পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং ব্যক্তির মন-মানসিকতাও অনেকাংশে দায়ী পরকীয়া
নামক এ ব্যাধির জন্য। আমি প্রথমে নিজের কিছু ঘটনা বলি- প্রায় ২৬ বছর হতে
চলল আমার বিয়ের বয়স। প্রথম কয়েক মাস বেশ রং-রসের মধ্যেই কাটল। এরপর রূঢ়
বাস্তবতা, অর্থকষ্ট। তারপর ছেলে সন্তানের জন্ম এবং তাদের মানুষ করার
নিরন্তর প্রচেষ্টা। স্ত্রীর দিকে তাকাতেই ফুরসত পাইনি, অন্যদিকে তাকানো তো
দূরের কথা। অথবা সুযোগই পাইনি বা আসেনি। আসলে কী হতো তা জানি না, এরই মধ্যে
সিকি শতাব্দীর দাম্পত্য জীবনে আমরা একে অপরের মন্দগুলোই যেন ভালোবাসার
পুষ্পমাল্য বানিয়ে নিয়েছি। যেমন আমার ভীষণ অপছন্দ নাক ডাকা। ইদানীং লক্ষ্য
করলাম তিনি নাক ডাকছেন। অভিযোগ করতেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার অবস্থা। উল্টো
অভিযোগ, আমি নাকি নাক ডাকি এবং তা ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দকেও ফেল করে। কি আর
করা। কখনো ঘুম ভেঙে গেলে ওই শব্দ শুনে পছন্দের রবীন্দ্রসংগীত মনে করে ছন্দ
মেলাতে শুরু করলাম। চিৎ হয়ে শুয়ে নিজের পেটটাকে তবলা বানিয়ে ছন্দে
অতিরিক্ত লালিত্য মেশানোর চেষ্টা করলাম। ওষুধের মতো কাজ দিল। এখন অভ্যাস
এমন হয়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে ওই ছন্দময় গীতসংগীত শ্রবণের জন্যই হয়তো বা
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।
যা বলছিলাম; পরকীয়া। পরিচিতজনদের কাছে এসব কথা শুনি। খুবই রগরগে। আমার মতো
নিরামিষভোজীও উত্তেজিত হয়ে উঠি। ভয়ঙ্কর সব লালসার গল্প। নিজে যেরূপ
অন্যায়ের পথে সমর্পিত হচ্ছে, তদ্রূপ ইচ্ছা করেই স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূদের
অনৈতিক কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। মদ, জুয়া ও অশালীনতার শত সহস্র আসর ঢাকার
অভিজাত পল্লীগুলোতে জমজমাট হয়ে ওঠে; বিশেষত সন্ধ্যার পর। এর সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের মানসিকতা। কোনো মানুষ যে পরকীয়া দোষে দোষী নয়-
এ কথা আর বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার দুটি লেখা
ছাপা হওয়ার পর আমি এত টেলিফোন এবং প্রতিক্রিয়া পেলাম যে তা ভাষায় প্রকাশ
করতে পারব না। প্রথম লেখাটি ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা, অন্তরালে যৌনতা এবং
দিনান্তের পতন। মূলত এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক লেখা। রাজা-বাদশাদের অনৈতিক,
প্রেম ও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কয়েকটি উপাখ্যান। অনেক রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী
ফোন করে তাদের স্বামীদের অপকর্মের কথা বলল, এমনকি নামধাম প্রকাশ করে আমাকে
তাদের দুঃখের কাহিনী প্রকাশ করতে বলল। কয়েকজন ফোন করে দেখা করতে চাইল।
নিজেদের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের রক্ষিতা বলে পরিচয় দিল এবং তাদের
কাহিনীগুলো আমাকে জানাতে চাইল।
অন্য একটি লেখা ছিল- 'শাওনের কান্না, মিলি ভাবী এবং আমার প্রেম'। এটাও
অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। বন্ধুবর সম্পাদক নঈম নিজামের প্রতি
ভীষণ রাগ হলো। কারণ শিরোনামটি তারই দেওয়া- আমারটি ছিল অন্যরকম। যারা পড়ল
তারা বিভিন্নভাবে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল। যারা শুধু শিরোনাম পড়ল
তারা আমাকে সরাসরি চরিত্রহীন ভাবল। অনেকে আবার অন্যের মুখে শুনে আমাকে
বাঁকা হাসি দিয়ে প্রশ্ন করল, আমি প্রমাদ গুনলাম স্ত্রী মহোদয়াকে নিয়ে।
ঢাকার বাইরে ছিলাম। এসে বুঝলাম সে পড়েনি। শাওন মানে লেখক হুমায়ূন আহমেদের
বিধবা স্ত্রী। কোনোদিন কথাও হয়নি কিংবা চাক্ষুষ দেখিনি। তার মা আমাদের
সহকর্মী। সবাই অভিযোগ করছে, শাওন কেবল অর্থলোভেই হুমায়ূনকে বিয়ে করেছে।
আমার মনে হলো, এটা ঠিক নয়। সে সত্যি অর্থেই হুমায়ূনের মেধা ও লেখক
প্রতিভাকে ভালোবেসেছে। তার বয়সে সে স্বাভাবিকভাবেই সুদর্শন কোনো যুবককে
ভালোবাসবে। অন্যদিকে অর্থের জন্য ভালোবাসার তো প্রশ্নই আসে না। যে কারণে
মানুষের অর্থলোভ হয় সেটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সে ধনীর মেয়ে এবং
হুমায়ূন আহমেদের বিত্ত-বৈভবের তুলনায় তার পৈতৃক ধনসম্পত্তি অনেক বেশি।
অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারকে নিয়ে যে সন্দেহ অনেকে করছে তাও আমার
কাছে বিকৃত রুচির মানসিকতাই মনে হয়েছে। যে মানুষটি অসুস্থ হুমায়ূনের শিয়রে
ছিলেন বছরের পর বছর। ব্যয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। ব্যবসা, বাণিজ্য, অফিস
ছেড়ে যেভাবে তিনি হুমায়ূন আহমেদের পাশে থেকেছেন- সেই দৃষ্টান্ত আমি নিকট
বর্তমানে দেখিওনি কিংবা শুনিওনি। কাজেই মানবিকতাবোধ থেকেই তাদের পক্ষে
লিখেছি। কিন্তু সমাজের বিকৃত মানুষেরা সরাসরি আমাকেই আক্রমণ করে বসল। কেউ
বলল- আপনি কে? আপনার লেখার কী দরকার ছিল! আপনার তো একটি ইমেজ রয়েছে। কেন
এসব ফালতু বিষয় নিয়ে লিখতে গেলেন ইত্যাদি। অদ্ভুত একটি এসএমএস পেলাম অজানা
জায়গা থেকে। সে লিখেছে- 'তোর গায়ের রং যেমনি কালো, তেমনি তোর অন্তরটা আরও
কালো। তাই কালিয়ার খোঁজে নেমেছিস।'
অদ্ভুত এই বিচিত্র সেলুকাসের দেশে মানুষের মন যে কিরূপ বিকৃত হয়ে পড়েছে তা
হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করলাম এবং পরকীয়ার
মনস্তাত্তি্বক কিছু বিষয় বোঝার চেষ্টা করলাম। ইচ্ছা ছিল খুশবন্ত সিংয়ের মতো
নিজের জবানিতে লিখব। কিন্তু সম্মানিত পাঠকদের কথা ভেবে সাহসী হলাম না।
একটি কল্পিত চরিত্রের মাধ্যমে আমার দেখা সমাজের কিছু দৃশ্যের কথা আপনাদের
বলছি- জয়নাল সাহেব এখন বেশ সচ্ছল। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি। ব্যবসা
করেন। লোকজন তাকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানে। সত্তরের দশকে প্রথম সিনেমা
দেখেন রূপবান। নায়িকা সুজাতাকে তার খুবই পছন্দ হয়। সিনেমাটিতে রূপবানের বয়স
১২ বছর আর নায়কের বয়স ১২ দিন। জয়নাল সাহেবের সেই থেকেই চিন্তা- ১২ দিনের
ছেলে রহিমের যদি বিয়ে হতে পারে, তবে ১৪ বছরের জয়নালের কেন নয়। সে সিনেমাটি
কয়েকবার দেখল। গানগুলো সব মুখস্থ হয়ে গেল। তার নায়িকা রূপবানকেও ভালো লাগল,
আবার ভিলেন নায়িকা তাজেলকেও ভালো লাগল। তার প্রশ্ন জাগল, দুটি বউ থাকলে কি
এমন হয়! তার দাদার তো চারটা বউ রয়েছে। যেই কথা সেই কাজ- ১৪ বছরের কিশোর
জয়নাল হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজতে লাগল। খুঁজতে লাগল মানে প্রেম করার সুযোগ
খুঁজতে লাগল। সময়টা সত্তরের দশক। সমাজ অনেকটা কনজারভেটিভ। মেয়েরা আরও বেশি।
জয়নাল সাহেব যত বেশি বেশি মেয়েদের দিকে তাকায় তারা ততই বিরক্ত হয়। কয়েকটি
মেয়ে তাদের অভিভাবকের কাছে নালিশ করল। কেউ কেউ স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে
অভিযোগ করল। জয়নালকে শিক্ষকরা বেশ মারল। মার খেয়ে তার প্রেমাকাঙ্ক্ষা আরও
বেড়ে গেল। বিশেষত হিন্দু মেয়েদের প্রতি তার মোহ ছিল বেশি। কেন জানি হিন্দু
মেয়েদের তার খুব রূপসী মনে হতো। আর প্রায় সব হিন্দু মেয়েই গান জানে। জয়নাল
সাহেব আবার শৈশব থেকেই ছিলেন সংগীতপ্রিয়।
কথায় আছে- মানুষ যা আকাঙ্ক্ষা করে এবং চেষ্টা করে, ফলাফল সেরকমই হয়। জয়নাল
সাহেব বিয়ে করে ফেললেন অল্প বয়সেই। প্রথম কয়েক মাস খুব রং-রসের মধ্যে গেল।
স্ত্রী সুন্দরী, অনুগতা এবং পতিব্রতা। বেশ ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তি
বাধাল রূপবান সিনেমার কাহিনী। জয়নাল সাহেবের বার বার মনে হচ্ছিল, খল নায়িকা
তাজেলের কথা। তার মনে হলো তাজেলের মতো আরেকটা মেয়ে পেলে মন্দ হতো না। চুপি
চুপি কিছুদিন প্রেম করবে। তারপর একদিন বিয়ে করবে। দুই বউ। বেশ মজাই হবে।
জয়নাল সাহেব মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত। কল্পিত তাজেলকে সে পাশে বসায়, খাইয়ে
দেয়। মাঝেমধ্যে খুনসুঁটিও করে। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময়। স্ত্রী বকা
দেয়- কেন সে শুয়ে শুয়ে একা একা বিড় বিড় করে! জয়নাল সাহেবের পরিবার বেশ
ধর্মপরায়ণ। জয়নাল সাহেবও তদ্রূপ। বিয়ের কিছুদিন পরই সে দাড়ি রাখা শুরু করল।
তাজেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য জয়নাল সাহেব উঠেপড়ে লাগল। সময় পেলেই
বিভিন্ন মার্কেটে যায়। সেখানে অনেক মেয়ে দেখে কিন্তু পছন্দ হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজের সামনেও অনেক ঘুরল। এবার অনেককে পছন্দ হলো।
কিন্তু কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রেম করবে তা ভেবে পেল না। নিজের ক্লিন ইমেজের
জন্য বিষয়টি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারছে না। পরিকল্পনা করতে
হচ্ছে নিজে নিজেই। সে ভাবল টেলিফোনে রং নাম্বারে ফোন করে হয়তো কোনো ফল
পাওয়া যেতে পারে। যেই কথা সেই কাজ। প্রতিদিন বিকালে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে সে
গুলশান, বনানী ও ধানমণ্ডির ফোন নম্বরগুলোতে চেষ্টা করতে থাকল। এবার সে
প্রতিজ্ঞা করল- যেহেতু রিস্ক নিয়ে প্রেম করবে সেহেতু প্রেমিকাকে হতে হবে
ধনীর কন্যা, সুন্দরী এবং কিছুটা দেমাগী- অনেকটা তাজেলের মতো। চেষ্টা চলল।
কিন্তু সহসা কিছু হলো না। জয়নাল সাহেব হাল ছাড়লেন না। এরই মধ্যে ধানমণ্ডির
একটি নম্বরে কাঙ্ক্ষিত কাউকে পেয়ে গেলেন। কিশোরী মেয়ে। সবে এসএসসি পরীক্ষা
দিয়েছে। জয়নাল সাহেবের তুলনায় ১২ বছরের ছোট। জয়নাল সাহেব নিজের বয়স কমিয়ে
বললেন। মজার মজার কথা এবং নিজের পরিণত বয়সের চাতুরীমূলক অভিজ্ঞতার অভিনব
বর্ণনে তিনি মেয়েটাকে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেললেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে
প্রেমালাপ। এভাবে চলল প্রায় ১৫ দিন। মেয়েটির সুললিত কণ্ঠ এবং বংশ-পরিচয় তার
খুবই পছন্দ হলো। টেলিফোনে উচ্চতা, গায়ের রং, চুলের স্টাইল, আত্দীয়স্বজন
এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণ নিলেন। সবই পছন্দের। এবার চর্মচক্ষে দেখার পালা।
কিশোরীও পাগলপ্রায়। জয়নাল সাহেব চিন্তা করেন কীভাবে মেয়েটাকে ভাগিয়ে নিয়ে
বিয়ে করা যায়। আইনগত বাধা ছিল না, কারণ তখনো বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ নিরোধ
আইনটি হয়নি। বাধা শুধু সামাজিক। জয়নাল সাহেব ভাবলেন- পালিয়ে কোথাও চলে গেলে
এবং বিয়ে-থা হয়ে গেলে বোধহয় তেমন সমস্যা হবে না। উভয়ের সম্মতিতে
দেখা-সাক্ষাতে দিনক্ষণ ঠিক হলো। মেয়েটি এলো। জয়নাল সাহেবও গেলেন। কিন্তু
একে অপরকে দেখার পর উভয়েই হতাশ হলেন। মেয়েটি জয়নাল সাহেবের বয়স, উচ্চতা এবং
দাড়ি দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো। জয়নাল সাহেবের আত্দসম্মানে ভীষণ লাগল।
অন্যদিকে জয়নাল সাহেব যেমনটি আশা করেছিলেন মেয়েটি তেমন সুন্দরী ছিল না।
বিশেষত তার উপরের পাটির দাঁত একটু উঁচু থাকায় বার বার শুধু নিজের রূপবানের
কথাই মনে পড়ছিল। আলোচনা জমল না, ঘণ্টাখানেক ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে এলোমেলো
ঘোরাফেরা করে তারা যে যার স্থানে ফিরে এলো। এরপর কয়েকদিন টেলিফোনে হালকা
কথাবার্তা হলো। কিন্তু জমল না। জয়নাল সাহেব রাগের চোটে দাড়ি কামিয়ে ফেললেন।
লোকজন জিজ্ঞাসা করল হায়! হায়! এটা কী করলে। জয়নাল সাহেব বললেন- দেশের
অবস্থা ভালো না। দাড়িওয়ালা যুবকদের দেখলেই লোকজন ছাত্রশিবিরের কর্মী মনে
করে- তাই দাড়ি কামিয়ে ফেললাম। তাজেলের খোঁজে জয়নাল সাহেব যখন প্রাণান্ত
চেষ্টা করছেন তখন রূপবানের ঘরে দুটি সন্তান জন্ম নিল। বিবাহিত জীবনেরও
প্রায় ১৪-১৫ বছর হতে চলল। ইতোমধ্যে রূপবানরূপী স্ত্রীর রূপেও কিছুটা ভাটা
পড়েছে। সাংসারিক কাজে প্রায়ই খটর-মটর লাগে। স্ত্রী ঝগড়া শুরু করল।
মাঝেমধ্যে গালিও দেয়। আর ঝগড়া লাগলে স্ত্রী গ্রাম্যভাষায় তুই-তুকারি শব্দ
ব্যবহার করে। ধর্মভীরু জয়নাল সাহেব নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকল-
হায় আল্লাহ, এই ডাইনিটা যেন মারা যায়। এভাবেই চলছিল। কিন্তু এর মধ্যে সে
জানল যে, কারও জন্য মৃত্যু কামনা করলে নাকি তার আয়ু বাড়ে। সে ভয় পেয়ে গেল।
এখন কি হবে। সে কি স্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করবে। স্ত্রীর দীর্ঘায়ু চেয়ে
মোনাজাত করার চেষ্টা করল। কিন্তু মন সায় দেয় না। সিদ্ধান্ত নিল, এ ব্যাপারে
সে আল্লাহকে কিছুই বলবে না। যাই হোক সে ঘরে সময় কম দেওয়া শুরু করল এবং
তাজেল খোঁজার কাজ পুনরায় আরম্ভ করল। ইতোমধ্যে জয়নাল সাহেব ব্যবসা-বাণিজ্যে
বেশ প্রসার লাভ করেছেন। ব্যবসায়ী সমাজে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনেক
ধনাঢ্য ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার সখ্যও গড়ে উঠেছে। বিদেশেও যাওয়া
পড়ছে ঘন ঘন। অনেক পরিচিতজনের জীবনই দেখলেন অশ্লীলতায় পূর্ণ। তারা বিভিন্ন
মহিলার সঙ্গে অবৈধ প্রণয় করছে। শারীরিক মেলামেশা করছে। অনেকে এই
প্রণয়কর্মের জন্য আলাদা বাড়ি কিংবা বাগানবাড়িও নির্মাণ করেছে। অনেকে আবার
পাঁচতারা হোটেলগুলোকে ব্যবহার করছে দিনে কিংবা রাতে। পুরুষদের প্রণয়ের
সঙ্গী হচ্ছে বিবাহিত মহিলারা, বিশেষত ধনাঢ্য পরিবারের মহিলারা।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণীও শয্যাসঙ্গী হচ্ছে- তবে অর্থের বিনিময়ে।
এর বাইরে হাই সোসাইটির কলগার্লদের সঙ্গেও কিছু পরিচিত ব্যবসায়ীর নিয়মিত
যোগাযোগ তার দৃষ্টিগোচরে এলো। কিছু রসিক ব্যবসায়ী আবার দেশ-বিদেশের পরিচিত
নায়িকা বা মডেল কন্যাদের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরমের রসালো গল্প জয়নাল সাহেবের
কাছে বলল। কিন্তু এসব কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করল না। সম্ভবত আজন্ম কঠিন
পারিবারিক শিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতাবোধ তাকে অবাধ যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে
আগ্রহী করল না। বন্ধুরা তাকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করল। কেউ
কেউ নিজেদের বান্ধবীদের উপহার প্রদানের কথা বলল। কেউ কেউ আবার বলল- যাও
পারলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম কর, কিছু বলব না। জয়নাল সাহেব মনে মনে 'লা
হাওলা' পড়েন। এসব অশ্লীল মানুষকে এড়িয়ে চলা আরম্ভ করলেন। ফলে বেশ কিছু দিন
তার মন ভারি হয়ে রইল। এদিকে জয়নাল সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তেই
থাকল। নিজের বংশ-আভিজাত্য ধর্মবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষার কারণে তিনি
চাইলেন স্ত্রীর সঙ্গে একটি মোহময় ও প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে তোলার। কিন্তু
স্ত্রী যেন কেমন। সবকিছুতেই তার একটা গেঁয়ো ভাব। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের
মধ্যে প্রেম-রোমান্টিকতা যে থাকতে পারে তা ভদ্রলোকের স্ত্রী বুঝতেই চান না।
রান্না-বাড়া, ঘরের কাজ, সন্তান-সন্ততি দেখাশোনা করা এবং কালেভদ্রে স্বামীর
শয্যাসঙ্গী হওয়াকেই তিনি তার দায়িত্ব মনে করেন। অন্যদিকে জয়নাল সাহেব চান
স্ত্রীর সঙ্গে সব বিষয় শেয়ার করতে। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, ভালোলাগা সবকিছুই
স্ত্রীকে বলতে চান। কিন্তু এতে স্ত্রী ভীষণ বিরক্ত হন। জয়নাল সাহেব যদি
দীর্ঘক্ষণ নামাজ পড়েন কিংবা বই পড়েন বা গান শোনেন- সব কিছুতেই স্ত্রীর
আপত্তি। স্ত্রী চান জয়নাল সাহেব যেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন।
সকাল-বিকাল পালা করে তাদের পড়ান। স্কুলে নিয়ে যান। ঘরের কাজে স্ত্রীকে
সাহায্য করেন। বাজারঘাট নিয়মিত করেন ইত্যাদি। জয়নাল সাহেবের বক্তব্য,
ওইগুলো তো টাকা দিয়েই করা যায়। ঘরের কাজ বুয়ারা করবে। রান্নার কাজ বাবুর্চি
করবে। ছেলেমেয়েদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখা হবে। নাহ, তা হবে না- স্ত্রীর সাফ
জবাব। জয়নাল সাহেব অনেক কষ্ট করে গ্রাম থেকে কাজের ছেলে বা মেয়ে আনেন। আর
স্ত্রী মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে গ্রামে জয়নাল সাহেবের স্ত্রীর
বদমেজাজের বেশ সুখ্যাতি হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে আর কাউকে আনা যাচ্ছে না। ফলে
ভদ্র মহিলাকে সব কাজ একাকীই করতে হয়। এ নিয়ে জয়নাল সাহেবের স্ত্রীর প্রতি
বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। বরং প্রচণ্ড রাগ হয়। কাজের লোকদের সঙ্গে
ঝগড়াঝাটি তিনি একদম পছন্দ করেন না। আর স্ত্রীর এ ধরনের গৃহকর্মে মনোনিবেশও
তার অপছন্দ। তিনি চান স্ত্রী তার অফিসে মাঝেমধ্যে আসুক। সামাজিক জীবনের
সঙ্গিনী হোক এবং অবসরে তার সঙ্গে প্রেম করুক। কিন্তু স্ত্রীর ভালোবাসা যেন
গৃহকোণে বন্দী থাকার মধ্যে এবং সারা দিনের কর্মশেষে যখন জয়নাল সাহেব বাসায়
ফেরেন তখন তার সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য নিত্যনতুন পরিকল্পনা প্রণয়নের মধ্যে।
ফলে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে জয়নাল সাহেবের মনও তাজেলের খোঁজে পুনরায়
অস্থির হায় ওঠে। মনের মতো আরেকটা বউ পাওয়ার জন্য জয়নাল সাহেবের সবচেয়ে বড়
সমস্যা হলো তার রোমান্টিক মন। সে বিয়ে করার আগে বউয়ের রোমান্টিকতা যাচাই
করতে চায়। এ জন্য দরকার প্রেম করা। অন্যদিকে বর্তমান স্ত্রী বা সন্তানদের
প্রতি দায়িত্ববোধও তাকে তাড়িত করে। স্ত্রী ও সন্তানদের সে প্রচণ্ড
ভালোবাসে। স্ত্রীকে মনের মতো করে না পাওয়ার বেদনা থেকেই সে বিকল্প কিছু
একটা খুঁজছে। খোঁজাটা আবার যেনতেন নয়। সে চাচ্ছে তার হবু দ্বিতীয় স্ত্রী
রূপ-গুণ-বংশ মর্যাদায় তার প্রথম স্ত্রীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ হোক। বর্তমান
স্ত্রী প্রায়ই তাকে খোটা দেয়- আমার মতো স্ত্রী আর পাবে না। মরলে দেখো, আরও
একটা বিয়ে করে দেখো, তোমার যে অভ্যাস- আমি বলে ঘর করে গেলাম। অন্য মহিলা
হলে একদিনও তোমার সঙ্গে থাকতে পারবে না ইত্যাদি। জয়নাল সাহেব উত্তর দেন না।
কিন্তু মনে মনে জিদ ধরেন- যা থাকে ভাগ্যে! কিছু একটা এবার করে দেখাতেই হয়।
এদিকে বয়স বেড়ে যাচ্ছে। চুলেও পাক ধরেছে। এ অবস্থায় কী করে আরেকটি বিয়ে
করা যায়। বিষয়টা নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে সে খোলামেলা আলোচনা করলেন। বন্ধু
বললেন- আরে বোকা, যারা দ্বিতীয় বিয়ে করে তারা কখনো প্রথম স্ত্রী নিয়ে এত
ভাবে না। হঠাৎ করে ফেলে। কিন্তু কীভাবে? বন্ধু বলে বিয়ের কথা গোপন রেখে
কারও সঙ্গে প্রেম কর, অথবা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বল যে, তোমার স্ত্রীর
সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না ইত্যাদি ইত্যাদি। সবই তো বুঝলাম- বলেন জয়নাল সাহেব।
কিন্তু যাব কোথায়? তাকে পাব কোথায়? একবার সিদ্ধান্ত নেয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন
দেবেন। কিন্তু সাহস হয় না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেন, একটি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈকালিক সেশনে এমবিএ-তে ভর্তি হবেন। উদ্দেশ্য
সেখানে হয়তো কোনো সুন্দরী এবং যোগ্য মেয়েকে পাওয়া যেতে পারে। হোক না বিধবা,
কিংবা তালাকপ্রাপ্ত। দু'একটি সন্তান থাকলেও আপত্তি নেই। আগে কুমারী বা
অবিবাহিত কাউকে কল্পনা করা যেত। এখন আর সম্ভব নয়। যেমন চিন্তা তেমন কাজ।
একটি স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। খরচ পড়ল প্রায় ৫০
হাজার টাকা। প্রথম দিন ক্লাসে যাওয়ার আগে উত্তেজনায় ঘুমাতে পারলেন না। না
জানি কতজন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা দেখতেই বা কেমন হবে। তার সঙ্গে প্রেম
করবে তো। ইত্যাদি চিন্তা করতে করতে নির্ঘুম রাত অবশেষে পোহাল। সারাদিন গেল
উত্তেজনায়। অবশেষে বিকালে ক্লাসে গেলেন জয়নাল সাহেব। ওরে বাবা, একি! প্রায়
৬০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ে মাত্র চার-পাঁচজন। তাও আবার একে অপরের চেয়ে
কুৎসিত। এর মধ্যে সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটি জয়নাল সাহেবের পাশে বসল। একেবারে
গাঘেঁষে। বয়সও তো মনে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছিল।
জয়নাল সাহেব তাকাতে ভয় পাচ্ছিলেন। মেয়েটিই উদ্যোগী হয়ে কথা বলল। মুখ থেকে
দুর্গন্ধের ঝাপটা জয়নাল সাহেবকে আক্রমণ করল। তিনি ওয়াশ রুমে যাওয়ার কথা বলে
ক্লাসরুম ছাড়লেন। আর কোনোদিন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়েও হাঁটেননি।
জয়নাল সাহেবের ক্লান্ত এই প্রেমযাত্রায় সত্যিই এবার ফুল ফুটল। এক ভদ্র
মহিলার সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় হলো। বেশ সুন্দরী ও লম্বা। গায়ের রং দুধে আলতা।
ঠিক যেমনটি তিনি কল্পনা করতেন। বংশও ভালো। ব্যবসা করেন। বোরকা পরেন, কিন্তু
নিচে জিন্স প্যান্টও পরেন। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করেন। নামাজ-কালাম, কোরআন
পড়া, নফল ইবাদত-বন্দেগি, রোজা রাখার মতো ধর্মীয় গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে
আধুনিক গানের গলাও বেশ দরাজ। বিবাহিত। বয়স ২৮-২৯ বছর হবে। দুটো সন্তান
রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। ধর্মভীরু জয়নাল সাহেব মনে করলেন,
এবার বোধহয় আল্লাহপাক তার প্রতি রহম করেছেন। আলাপ জমে উঠল- ফোনে ফোনে। কারণ
দেখা হয়েছে মাত্র একবার এবং তিনি পর্দার কারণে দেখা-সাক্ষাতে আগ্রহী নন।
প্রেয়সীর বয়স যেহেতু কম, সেহেতু জয়নাল সাহেবকেও শারীরিকভাবে সক্ষমতা অর্জন
করতে হবে। তিনি নিয়মিত ব্যায়াম শুরু করলেন। ডাক্তারের কথামতো সন্ধ্যা ৮টার
মধ্যে খাবার খান। এরপর হাঁটতে বের হন। টানা দেড় ঘণ্টা হাঁটেন ধানমণ্ডি
লেকের পাড়ে। হাঁটতে হাঁটতে যখন জাহাজ মার্কা বাড়ির সামনে দাঁড়ান তখন সেখানে
প্রেমরত তরুণ-তরুণীদের দিকে আড় চোখে তাকান। বেশ জড়াজড়ি করে তারা বসে থাকে।
কী করে অন্ধকারে তা স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যায় আপত্তিকর কিছু একটা
করছে। আগে খুব রাগ হতো এ ধরনের দৃশ্য দেখলে। মনে হতো একটি লাথি দিয়ে ওদের
তাড়িয়ে দেন। কিন্তু এখন হয় না। বরং এক ধরনের মায়া লাগে। আহারে! বেচারারা
কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। সে মনে মনে ভাবে বিয়ের পর নববধূকে নিয়ে প্রায়ই সে
ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে বসবে। বিশেষত জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে। বাদাম কিংবা
পপকর্ন খাবে এবং পছন্দের গানগুলো তাকে গেয়ে শোনাবে। এভাবেই চলল প্রায় ১৫-২০
দিন। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেক দুর্ঘটনা। জয়নাল সাহেবের দীর্ঘদিনের পরিচিত
এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। খানিকটা প্লেবয় প্রকৃতির। কথা প্রসঙ্গে
জানাল, সে তার হবুবধূ বন্ধুটির বেশ পরিচিত। নিজের মনের কথা গোপন রেখে সে
মেয়েটির খোঁজখবর জানতে চাইল। সমাজে সৎ মানুষ হিসেবে যেহেতু জয়নাল সাহেব
ব্যাপক পরিচিতি এবং বিশ্বস্ততা রয়েছে, তাই বন্ধুটি কোনো সন্দেহ করল না। বরং
নির্দ্বিধায় মেয়েটির ইতিহাস বর্ণনা করল। জানা গেল, মেয়েটি মূলত হাই
সোসাইটির কলগার্ল। সমাজের অনেক বিত্তবানকে সে সর্বনাশ করেছে। কিছুতেই
বিশ্বাস হচ্ছিল না জয়নাল সাহেবের। বন্ধুটি কয়েকজনের নাম বললেন এবং এও
বললেন- কে কত টাকা ওই মেয়ের পেছনে খরচ করেছে। জয়নাল সাহেব এসএমএস দিয়ে
মেয়েটিকে ঘটনার সত্যতা জিজ্ঞাসা করলেন এবং মেয়েটিও নির্দ্বিধায় সব স্বীকার
করল। মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো জয়নাল সাহেবের। মনের দুঃখে তিনি চলে
গেলেন ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে সেই জাহাজ মার্কা বাড়িটির কাছে। রাত তখন প্রায়
১১টা। কোনো প্রেমিক জুটিই সেখানে ছিল না। কেবল জয়নাল সাহেব একা। আনমনে
তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত চাঁদের দিকে। কোনো খেয়াল ছিল
না। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলেন; কাঁধে কার যেন শক্ত হাতের স্পর্শে। তাকিয়ে
দেখলেন একজন হিজড়া তার ঘাড়ে হাত রেখে অশ্লীলভাবে হাসছে। ভয়ে জয়নাল সাহেবের
মুখ পাংশু বর্ণ হয়ে গেল। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে কাউকে ডাকবেন সেই
শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন...।
প্রকাশঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, শুক্রবার ২৬ অক্টোবর ২০১২